ঢাকা মেইল ডেস্ক
২৩ আগস্ট ২০২২, ০৯:৩৯ পিএম
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে তাগিদ করে বলেছে, খেলা হবে। সেই সঙ্গে খেলার ধরণও বলেছে তারা। জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ মোকাবিলা করতে চায় রাজপথে। বিরোধী শিবিরের আন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ক্ষমতাসীন দলটি আরও জানিয়েছে, এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি দৃঢ় চিত্তে দলটির মুখপাত্রবৃন্দ বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে সাতটি চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলা করা। এছাড়া দুই নম্বর চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক শক্তির চাপ সামলিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। তিন-এ রয়েছে জনশ্রেণির আস্থা অর্জনে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। পাশাপাশি চার নম্বর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে ক্রেডিবল একটি কাউন্সিল বা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করা।
অন্যদিকে, পাঁচ নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে রয়েছে রাজনৈতিক জোটকে পুনরায় গুরুত্ব দিয়ে সমমনাদের মূল্যায়ন করার বিষয়টি। এছাড়া ছয় নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দলটির সামনে রয়েছে- প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সে সব আমলাদের শনাক্ত করা, যারা একটি বিশেষ শক্তির স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে বা যেতে পারে। সবশেষ সাত নম্বরে রয়েছে সুশীল সমাজের নামে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীদের উপদ্রব প্রতিহত করা।

আওয়ামী লীগ, তৃতীয় মেয়াদের অর্ধেক সময়ের বেশি পার করেছে। আগামী দেড় বছরের কম সময়ের মধ্যে আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু, এই সাত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ প্রস্তুত রয়েছে কি না তা নিয়ে আলোচনা চলছে। গেল বুধবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনে খেলা হবে, সেখানে আমরা জয়লাভ করব। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।’
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক ভূমিকা পরখ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আন্দোলনমুখর হয়ে যে কোনো সময় রাজপথে নামবে বলে মনে করার সুযোগ আছে। গেল বুধবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারকে অবিলম্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
ফখরুল আরও বলেছেন, ‘সফরকারী জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট ও তার দল ১৪-১৮ আগস্ট বাংলাদেশ সফরে এসে এখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বাক-স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে লিখিত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বিরোধীমত, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রকাশিত প্রতিবেদনেরই প্রতিচ্ছবি বলে আমরা মনে করি।’
ফলে আওয়ামী লীগ এখন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও সমমনাদের আসন্ন আন্দোলনকে রুখে দেওয়ার জন্য কি ধরণের কৌশল হাতে নেবে তা নিয়েও আলোচনা দৃঢ় হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চাপ বিবেচনায় তাঁরা কীভাবে রাজনৈতিক নীতি প্রণয়ন করে মিত্র সম্পর্ক তৈরিতে বিজয়ী হবে- তা রীতিমত একটি চ্যালেঞ্জ হয়েই দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াবে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত দিচ্ছেন।

তবে তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি নতুন। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ সরবরাহের অপ্রতুল কাঠামো উন্মোচিত হওয়া, নিত্য পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া, মধ্যবিত্তের সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের প্রতি জনআস্থা কমেছে। অথচ, সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন প্রাক্কালেও দলটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী পর্যায়ে বিরাজ করছিল। যদিও আওয়ামী লীগ তথা খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, ‘বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে জ্বালানি সরবরাহের অপর্যাপ্ত সমীকরণে সাময়িক সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সর্বদা থাকবে না। লোডশেডিং থাকবে।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গেল মঙ্গলবার এ-ও বলেছেন, ‘সমাজের বিত্তবানেরা এগিয়ে আসুন। যারা খারাপ আছে, তাদের পাশে দাঁড়ান। সরকার তো থাকবেই।’- এমন উক্তির গভীর বিশ্লেষণে গেলে বোঝাই যাচ্ছে, দেশপ্রধান নিজেও অবগত যে, জনশ্রেণির একটি অংশ খুব বেশি ভালো নেই। কাজেই আওয়ামী লীগকে পুনরায় জনআস্থা অর্জনে মনযোগী হয়ে দেশ সেবায় থাকতে হবে বলে মনে করার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জটি হলো- দলের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে উত্তরণে গিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অর্থবহ সম্মেলন আবহে কাউন্সিল করা। এমনিতেই দলের সভানেত্রীর দুর্নীতি ইস্যুতে জিরো টলারেন্স থাকায় দলটির পুনর্গঠনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবার বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে দলের পদ-পদবীতে কিংবা নেতৃত্বে পরিবর্তন প্রত্যাশা করছে সারাদেশের নেতাকর্মীবৃন্দ।
এবারের কাউন্সিলে নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তা চাউর আছে। বিশেষত দলের তিন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্য থেকে এবার নতুন সাধারণ সম্পাদক কে দেখা যাবে বলেও গুঞ্জন আছে। এই গুঞ্জনে যে তিন নেতার নাম সুগভীর বাস্তবতায় আলোচনা বাড়াচ্ছে তাঁরা হলেন- ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক, এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। এছাড়াও আব্দুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, মির্জা আজম, বাহাউদ্দীন নাসিম, দীপু মনি, হাছান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস উল্লেখযোগ্য পদে অধিষ্ঠিত হবেন- তা নিয়েও খোলামেলা আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট কিংবা মহাজোটের পরিণতি নিয়ে উদারনীতির প্রত্যাশায় রয়েছে সমমনা সংগঠনগুলোও। সেই ধারাবাহিকতায় জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বের জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ অপরাপর দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিভাত হয়।
এছাড়াও গেল এক বছর ধরে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) চেয়ারম্যান জিএম কাদের পুরোপুরিভাবে সরকারের সমালোচনায় ব্যক্তিগতভাবে সিক্ত থেকে রাজনীতি করছেন বলেও কথিত আছে। এমতাবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জাতীয় পার্টীর সঙ্গে সমন্বয় করার দিকটিকেও আওয়ামী লীগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রচলিত আছে- সচিব, উপসচিব থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনপুষ্ট দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত আছেন- এমন আমলার সংখ্যা নেহাতই কম নয়। বিরোধী শক্তির আন্দোলনকে সফল করতে তাদের ভূমিকা সরকারের বিপক্ষে সহায়ক হতে পারে। তাঁদেরকে চিহ্নিত করাটাও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
এদিকে, সুশীল সমাজের অতি উৎসাহী হয়ে রাজনৈতিক বচনকে সুশীল উপদ্রব হিসাবে দেখার সুযোগও আছে। তাঁরা নীতি কথা বলে দেশের বুদ্ধিমান মানুষগুলোর সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন- এমন কথাও প্রচলিত আছে। কিন্তু, তাঁরা নিজেরাই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী গোত্রের হন, বাংলাদেশের ইতিহাস তাই বলে। তেমন ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির বাঁকা পথে ক্ষমতা নেওয়ার একটা চেষ্টা তাদের ছিল, আছে ও থেকে যাবে। এমন পরিস্থিতির আলোকে ক্ষমতাধর সুশীল সমাজকেও আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে। তাঁরা বসে নেই বলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জানান দেয়।
সবমিলিয়ে সাত চ্যালেঞ্জের সামনে আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ হাসিনা। হয়তো সেই কারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আশাবাদী হতে পারেন। তাঁর পক্ষে সংকট কিংবা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। তবু, প্রশ্নটা থাকুক- আওয়ামী লীগ কি পারবে সবকিছু সামাল দিতে?
লেখক: সাংবাদিক।
বিইউ/আইএইচ