হারুন জামিল
৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩১ পিএম
বেগম খালেদা জিয়া এখন অন্যলোকের বাসিন্দা। ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় তাঁর জীবনাবসান ঘটেছে। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নভেম্বর মাসের শেষার্ধ থেকে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে তিনি চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছেন। আজ বুধবার দেশের ইতিহাসে তাঁর বৃহত্তম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। এই জানাজায় কত লোকের সমাগম ঘটেছে এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। প্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউ, সংসদের সুবিশাল চত্বর এমনকি আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ছিল এককথায় জনারণ্য। সারাদেশে যারা এ জানাজায় শামিল হতে পারেননি তারাও হৃদয়ের সব আবেগ ভালোবাসা দিয়ে ছিলেন দোয়ায় শামিল। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষতো বটেই দেশের আলেম ওলামা পীর মাশায়েখ ধার্মিক অধার্মিক নির্বিশেষে এই জানাজায় ছুটে গেছেন। এমন ভাগ্য সবার হয় না। এক জীবনে চিরবিদায় জানাতে এ ভালোবাসা নজিরবিহীন।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের মাঝখানে ঠাঁই নিতে পেরেছিলেন। এর আগে তাঁর স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও শেষ বিদায়ে বিরল এই ভালোবাসায় সিক্ত হন। ১৯৮১ সালে বিপথগামী সেনা অফিসারদের এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে তিনি শাহাদাতবরণ করলে তাঁর জানাজায়ও মানুষের ঢল নেমেছিল। তারপর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এক দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমে বেগম খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে ভূষিত হন। তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ বন্ধুর ঘটনাবহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনি ছিলেন এ পথে অবিচল। বিশ্বাস আস্থা ও দৃঢ়তা তাকে অনন্য মর্যাদায় সিক্ত করেছে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল খুবই স্পষ্ট। কোনো ভয়ভীতির কাছে তিনি নত হননি। রাষ্ট্রীয় জুলুমে তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু দুমড়ে-মুচড়ে পড়েননি। বেগম খালেদা জিয়া এই দুঃখক্লিষ্ট আবেগতাড়িত জনগোষ্ঠীর একমাত্র নেতা যিনি মানুষের হৃদস্পন্দন বুঝতে পেরেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় তিনি সব রক্ষণশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও নিজকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন মৃদুভাষি। কিন্তু তাঁর পরিমিতিবোধ ছিলো অসাধারণ। আভিজাত্য ও রক্ষণশীলতার এক অদ্ভুত মিশেল ছিলো তাঁর মধ্যে। আধুনিক ও পরিপাটি ছিল তাঁর জীবনাচরণ। শালীন ও রুচিশীলতার মিশেলে যে জীবনবোধ তাকে তাড়িত করেছে তা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক রাজনীতির বিপরীতে তিনি তাঁর নিজস্ব রাজনীতি করে গেছেন। গালির বিপরীতে সংযমী আচরণ এবং উদার ও সহনশীলতা তাকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। তাকে কোনো দিন বলতে শুনিনি ’আমি ধার্মিক। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি।’
বাংলাদেশের রাজনীতি সমাজ কাঠামোকে বিভক্ত করে দিয়েছে। এ দেশে রাজনৈতিক মানস গঠন হয়েছে বিভক্তিকে পুঁজি করে। শিক্ষাব্যবস্থা সুনাগরিক তৈরির বদলে এমন এক মিশ্র জনগোষ্ঠী তৈরি করছে যারা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন নয়। আর ইতিহাস তৈরি হয়েছে শাসকের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিয়ে। এই ইতিহাস অকাট্য নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ নয়। ঘৃণার চর্চা রাজনীতিতে সুস্থধারা তৈরির বদলে বিভক্তি ও হিংসা উস্কে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত হিংসা ও ঘৃণার চর্চা জাতিকে অসুস্থ করে দেয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরতে পরতে এ ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। বেগম খালেদা জিয়া এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নিজের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় অবিচল থেকেও যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যায় সেই উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি ঘৃণার রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন।
সাংবাদিকতার দীর্ঘ সময়ে বেশ কয়েকবার দেশের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন দেখেছি তাঁর পরিমিতিবোধ, সৌজন্যতা, বিনয়ী আচরণ যেকোন মানুষকে মুগ্ধ করার মতো। তিনি প্রায় প্রত্যেক রমজানেই জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক ইউনিয়নের ইফতার মাহফিলে আসতেন। ২০০০ সালে একবার রমজানে ইফতার মাহফিলে তিনি প্রেসক্লাবে এলে লাউঞ্জে দীর্ঘ সময় বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। সাংবাদিকরা তৎকালীন সরকারের নিপীড়নমূলক কাজের সমালোচনা করছিলেন। বেগম খালেদা জিয়াকে দেখেছিলাম চুপচাপ বসে সেসব কথা শুনতে। তিনি দুয়েকটা কথার উত্তর দিলেও তা ছিলো খুবই সৌজন্যমূলক এবং ভদ্রতা বজায় রেখে। খুব স্বল্প আহার গ্রহণ করেছিলেন সেদিন।
রাজনীতিতে তিনি শহীদ জিয়ার রোল মডেল ফলো করতেন। দেশপ্রেমের রাজনীতিই ছিলো তাঁর আদর্শ। বাংলাদেশ ভিন্ন তার চিন্তা চেতনায় আর কিছু ছিল না। তাঁর চিন্তাধারা ছিল খুবই পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ। মনে পড়ে পার্বত্যচট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। একজন রিপোর্টার হিসেবে ওই লংমার্চ কাভার করার দায়িত্ব পড়েছিল আমারও। কাঁচপুর ব্রিজের কাছে নারায়ণগঞ্জের সেকালের গডফাদার লংমার্চ বহরকে আটকে দিয়েছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা সেখানে আটকে থাকার পর বিচ্ছিন্নভাবে গাড়ির বহর নিয়ে আমরা রওনা হই। লংমার্চ বহরে হামলার মুখেও সেদিন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবিচল ছিলেন এবং একটা তেলপাম্পে নামাজ আদায় করে আবার রওনা হন। তিনি ছিলেন সৎ জীবনযাপনকারী এবং জাতীয় স্বার্থে আপসহীন। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে ম্যাডাম জিয়া তখন গৃহবন্দি।
পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে বন্দি সাবেক মন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মরহুম জননেতা তরিকুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমাকে মাঝেমধ্যেই যাওয়া লাগতো। একদিন তরিকুল ভাই আমাকে বললেন, পাশের রুমে আরাফাত রহমান কোকো আছে। তুমি গিয়ে কথা বলো। আমি রুমে যেতেই আরাফাত রহমান কোকো আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। সম্ভবত: স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারণে তিনি কাঁপছিলেন। আমি তাকে বসতে অনুরোধ করলাম। প্রায় এক ঘণ্টার সেই আলাপচারিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, আম্মা আজ বগুড়ার দই পাঠিয়েছেন। আর এইসব খাবার। তিনি আমাকে দই খেতে দিয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আম্মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই পরিস্থিতি থাকবে না। কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে দেশের এই অবস্থা হয়েছে তিনি সবই জানেন। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে।
আরাফাত রহমান কোকোকে আমার কাছে খুবই বিনয়ী ও অত্যন্ত ভদ্র মানুষ মনে হয়েছে। অথচ বিএনপির প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাকে নিয়ে কত নোংরামিই না করেছে! আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০০১ সালের পর জনাব তারেক রহমানের সঙ্গেও দেশের বিভিন্ন স্থানে রিপোর্টার হিসেবে সফর করার। তাকে তখন দেখেছি সারাদেশের বিএনপির তৃণমূলকে কীভাবে তিনি সংগঠিত করছেন এবং সকলকে উজ্জীবিত করে তুলছেন। একটা ল্যাপটপের মধ্যে তিনি সব কার্যক্রম সাজিয়ে ফেলেছিলেন। রাতে অনেক দিন তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং পরামর্শ চাইতেন। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোর মধ্যে শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন দেখা যেতো।
পারিবারিক শিক্ষা মানুষের কর্মে প্রকাশ পায়। নিজেকে শিক্ষিত দাবি করলেই তা হওয়া যায় না। বেগম খালেদা জিয়া একটি মুসলিমপ্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান দলের নেতা। এটি তিনি ভালোভাবেই অনুধাবন করতেন। কিন্তু এজন্য নিজের স্বকীয়তা ছেড়ে তাকে মুখোশ পরতে হয়নি। তাঁর আচরণ ও কর্মের মাধ্যমেই তিনি নিজকে তুলে ধরেছেন। ভন্ডামি ও স্ববিরোধিতার রাজনীতি তিনি করেননি। রাজনীতির কারণে তিনি কারো কাছে দাসখত দেননি। তাঁর দুর্ভাগ্য শেখ হাসিনার মতো প্রতিহিংসাপ্রবণ দুর্বিনীত একজনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া। জীবনের শেষ সময়গুলো বেগম খালেদা জিয়ার জন্য ছিল বেদনাদায়ক। তাকে অন্যায়ভাবে নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দূরপ্রবাসে ছোট ছেলের মৃত্যুকষ্ট তাকে নিদারুন যন্ত্রণাক্লিষ্ট করেছে। মাকে হারিয়েছেন কারাগারে থাকতে। তাঁর দলের লাখো কর্মীকে ঘরছাড়া করা হয়েছে। জুলুম করা হয়েছে । নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছে মিথ্যা অভিযোগে। ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি মাত্রাছাড়া কোনো কথা বলেননি। এটাই বেগম খালেদা জিয়াকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে কাজ করা অফিসারদের কাছে শুনেছি তিনি কখনোই কারো সাথে দুর্ব্যবহার করতেন না। রাষ্ট্রের কাজে আগে তিনি জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেন। ইসলামী মূল্যবোধকে তিনি সযত্নে লালন করতেন। আলেম ওলামাদেরকে সম্মান করতেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নিজস্বতা তিনি তৈরি করেছেন তা আর কেউ পারেননি। তিনি ছিলেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তাকে কেন্দ্র করেই গত চার দশক বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা পরিচালিত হয়েছে। সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার এই বিরল দক্ষতা ও গুন ছিল তাঁর মধ্যে। তৃতীয় বিশ্বের এমন এক দেশের নেতা তিনি ছিলেন যেখানে আবেগ দিয়ে রাজনীতির গতিপথ নির্ণয় করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু সেটা করতেন নিজস্বতা দিয়ে। তিনি ধার করা রাজনীতি করেননি। এ দেশের মানুষকে তিনি বুঝতেন। গভীর দেশপ্রেম দিয়ে বিচার করতেন রাজনৈতিক ভবিষ্যত। তিনি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজ দলের রাজনীতি করেছেন। পরিণত বয়সেই তিনি অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জন্য শোকার্তদের মিছিলে মানুষের অভাব হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া আরও বহুকাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তাঁর নীতি ও আদর্শ মানুষের হৃদয়ে জাগরুক থাকবে। মরণের পরও তিনি অমর হয়ে থাকবেন। মহান আল্লাহ এই মহিয়সী নারীকে চির শান্তির জান্নাতে আশ্রয় দিন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ঢাকা মেইল।