আলমগীর কবির
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫ পিএম
আজ সারাদিন সূর্য ওঠেনি। পৌষের হাড়কাঁপানো কনকনে ঠান্ডার সাথে আকাশজুড়ে ছিল এক গুমোট বিষণ্ণতা। প্রকৃতির এই বৈরী রূপের মধ্যেই ভোরে খবর এলো বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। প্রকৃতির এই আলোহীন দিনটি যেন বাংলাদেশের রাজনীতির একটি দীর্ঘ ও বর্ণিল অধ্যায়ের যবনিকার সাথেই মিলে গেল। আমাদের সাংবাদিকতা কিংবা সচেতন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের শুরু থেকেই দেশের রাজনীতির কক্ষপথ আবর্তিত হয়েছে মূলত দুটি নামকে কেন্দ্র করে, বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা। আজ তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই চেনা সমীকরণে এক বিশাল ও স্থায়ী ‘ছন্দপতন’ ঘটল।
রাজনৈতিক মেরুকরণে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা ছিলেন দুই মেরুর বাসিন্দা। আদর্শিক ভিন্নতা যাই থাকুক, দেশের আপামর জনতা এই দুই নেত্রীর মাধ্যমেই রাজনৈতিকভাবে নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেত। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন শেখ হাসিনা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে দেশত্যাগ করেছেন, ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ এবং অসুস্থ অবস্থায় থেকেও আগের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন।
সাংবাদিকতা বা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের অনেক আগে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। নরসিংদীর মনোহরদীর চালাকচরে বেগম খালেদা জিয়া এক জনসভায় এসেছিলেন। কৌতূহলী কিশোর মনে তাকে দেখার তীব্র আগ্রহ থেকে আমরা একদল বন্ধু ছুটে গিয়েছিলাম। ভিড় ঠেলে মঞ্চের একদম কাছে পৌঁছানোর সুযোগ হয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখা সেই দৃশ্যটি আজও আমার স্মৃতিতে অমলিন হাতে একটি টিস্যু নিখুঁতভাবে ভাঁজ করে রাখা, আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বের এক বিরল সংমিশ্রণ। সেদিন কেবল দলীয় কর্মী নয়, বরং সাধারণ মানুষ দলমত নির্বিশেষে তাকে একনজর দেখতে ভিড় করেছিল। পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে লোকসংগীত শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতীর চিকিৎসার অনুদানকে কেন্দ্র করে ওনার সাথে সামনাসামনি সাক্ষাতের বিষয়টি আমার কাছে সাংবাদিকতার বাইরের এক অনন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পথ মসৃণ ছিল না। তবে রাজনীতির কঠিনতম সময়গুলোতে তিনি দেশ ও মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে কখনো পিছু হটেননি। রাজনৈতিক মতভেদ গণতান্ত্রিক সমাজে চিরন্তন, কিন্তু তার যে ধৈর্য, সহনশীলতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অটল থাকার দৃঢ়তা তা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের রাজনীতিকদের জন্য একটি বিশেষ শিক্ষণীয় পাঠ।
সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে হয়তো দেশ একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী পাবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির যে মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোতে বেগম খালেদা জিয়া গত চার দশক ধরে প্রভাব বিস্তার করেছেন, সেই শূন্যস্থান খুব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। নেতৃত্বের পরিবর্তন আসবে, কিন্তু ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে তিনি যে উচ্চতা তৈরি করেছেন, সেখানে পৌঁছানো নতুনদের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
সূর্যহীন এই শীতের সকালে যে শোকের খবর এসেছে, তা কেবল একটি দলের জন্য নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাত নসীব করুন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার ও অনুসারীদের এই শোক সইবার শক্তি দান করুন।
লেখক: সাংবাদিক