images

মতামত

দেশমাতা! জেন-জি আপনাকে মিস করবে ভীষণ!

ঢাকা মেইল ডেস্ক

৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আপসহীনতার বাতিঘর, আপসহীন দেশনেত্রী ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টায় ইন্তেকাল করেছেন। নিখাঁদ বাংলাদেশপন্থী এই মহান নেত্রীর প্রয়াণে সারাদেশ আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় নীরব। 

রাষ্ট্রগঠনের ৫৪ বছরের ইতিহাসে ৪৩ বছর যাবত রাষ্ট্র-রাজনীতিতে প্রবহমান শীর্ষ ব্যক্তিত্বের স্থান লাভকারী এই মহিয়সী নারী বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বারবার অপরিসীম ত্যাগ ও কঠিন পরীক্ষার সমুখ্খীন হলেও প্রতিবারই তিনি দেশ ও জনগণের প্রতি যে মমত্ববোধ দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে বিরল। এমনকি আমরা দেখলাম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা অবস্থায় পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান যখন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, মৃত্যুকে সঙ্গী করে হাসপাতালে শুয়ে থাকা অবস্থায়ও তিনি দেশ ছেড়ে চিকিৎসা নিতে রাজি হননি। তাঁর এরকম হাজারো সিদ্ধান্তে বারবার উচ্চারিত হয়েছে, ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’।

কেবল দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন মনোভাবের কারণে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তাঁকে এক কাপড়ে ক্যান্টনমেন্টের ২৮ বছরের স্মৃতিময় একটি বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল তৎকালীন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার, সেদিন তাঁর চোখের পানি সারা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তখন আমি স্কুলে পড়তাম, স্কুল শেষে বাড়িতে ফিরে দেখি টিভির স্ক্রিনে খালেদা জিয়ার সাথে আমার পরিবারের ছোট-বড় সবারই চোখের পানি একাকার। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি দেখে তখন থেকেই অনুভব করতাম, বেগম জিয়া শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি একটি আবেগ, একটি অনুভূতির নাম।

সমগ্র দেশে একই রকম বেদনা ও আবেগ দেখেছি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যেদিন তাঁকে মিথ্যা মামলায় নিয়ে যাওয়া হল পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে। আর এবার, তিনি যখন রাজধানীর এভাকেয়ার হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন; তাঁকে নিয়ে চলেছে সারাদেশের কান্না, দোয়া, উৎকণ্ঠা। তাঁর সুস্থতার আশায় অসংখ্য মানুষ রোজা রেখেছেন, মোনাজাত করেছেন। এই ভালোবাসা একজন নেত্রীর প্রতি জাতির অকৃত্রিম মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।

তাঁর এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে ভারতীয় সেবাদাসী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিনা অপরাধে তাঁকে কারাগারে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে। এমনকি তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিষক্রিয়া পর্যন্ত প্রয়োগের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, যার পরিণতিতে তিনি হাসপাতালের বেডে দীর্ঘদিন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন।

এক সময়ের সাধারণ গৃহবধূ খালেদা জিয়া বর্ণাঢ্য ও অনন্য রাজনৈতিক যাত্রায় যে অসাধারণ সফলতা দেখিয়েছেন তা সারা পৃথিবীবাসীর জন্য অনন্য নজির হয়ে থাকবে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর তিনি বাধ্য হয়ে দলের হাল ধরেন। নীতির প্রশ্ন অটল এই মহিয়সী নারী দল ও সরকার পরিচালনায় করতে গিয়ে বহুবার তিনি মোকাবিলা করেছেন চরম সংকট ও ক্রান্তিকাল, তবে কখনোই আদর্শ বিচ্যুত হননি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাতবার গৃহবন্দি হন খালেদা জিয়া। ওয়ান-ইলেভেন ও হাসিনার আমলে মিথ্যা মামলায় দু’বার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করেন। ২০১৫ সালে কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত হন তিনি।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে তিনি তাঁর জীবনের এক করুণ অধ্যায়ের কথা দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কম বয়সে স্বামী হারিয়েছি। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি ছোট ছেলেকে হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে দূরদেশে। আমার এই স্বজনহীন জীবনে দেশবাসী আমার স্বজন।’

tAREQ

সারা জীবন দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে যে মহান মানুষটি সংগ্রাম করেছেন, আজ তিনি হাসপাতালের বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, বেগম খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশ একে অন্যের প্রতিশব্দ। মা যেমন তাঁর সন্তানকে গভীর মমতায় আগলে রাখেন, তিনিও তেমন পরম মমতায় সবকিছুর উর্ধ্বে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্মমতা বা ব্যক্তিগত জীবনের রোগ-শোক-দুঃখ কোনকিছুই দমিয়ে দিতে পারি তাঁকে।

আমরা জেন-জি প্রজন্ম শুধু ইতিহাসের পাতায় তাঁকে দেখতে চাইনি; বাস্তবেও ওনার পদাচারণা, বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা আশা করেছিলাম। কিন্তু মহাবিশ্বের অমোঘ সত্য 'মৃত্যু' আজ তাঁকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তবে এটাকে আমরা কখনোই সাধারণ মৃত্যু বলবো না, কারণ তিনি শাহাদাতের সুধা পান করেছেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ, আপোষহীন লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক। দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আপসহীনতার যে পিদিম তিনি জ্বালিয়েছিলেন, সারাবিশ্ব দেখেছে তাঁরই প্রজ্জ্বলিত পিদিমের সূত্র ধরে কিভাবে জেন-জি এদেশে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।

পরম করুণাময়ের নিকট ফরিয়াদ জানাই, হে মহামহিম আপনি আমাদের এই দুঃখিনী দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়াকে একজন শহীদ হিসেবে কবুল করে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমানে দেশ পুনর্গঠনের যে সময় চলছে, সে সময় তাঁর আদর্শিক চর্চা জাতিকে নতুনভাবে শ্বাস নিতে শেখাবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তিনি সবসময় আলো হয়ে থাকবেন।

লেখক: তরুণ কলামিস্ট ও হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট; গ্রাজুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়