images

মতামত

চব্বিশোত্তর বাংলাদেশ ও তারেক রহমান

ঢাকা মেইল ডেস্ক

২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১০ পিএম

দীর্ঘ সতেরো বছরের বেশি সময় নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় তার এই প্রত্যাবর্তন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো নেতার প্রবাস জীবন শেষে ফিরে আসা মানেই নতুন কোনো অধ্যায়ের সূচনা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি কেবল একজন নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের দীর্ঘদিনের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার অবসান। নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে তিনি যখন ফিরে আসছেন তখন দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর চব্বিশোত্তর বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিপুল প্রত্যাশার বলয়। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই ব-দ্বীপ এখন এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে তারেক রহমান হবেন সেই স্বপ্নের অগ্রপথিক। কারণ কেবল একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার ফেরা নয়, বরং একে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন।

তারেক রহমানের রাজনীতি শুরু হয়েছিল তৃণমূলকে কেন্দ্র করে। ‘তৃণমূল সম্মেলন’ এর মাধ্যমে তিনি যেভাবে গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে থেকেও তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, দেশে ফিরে তিনি আবার সেই তৃণমূলভিত্তিক রাজনীতিকে চাঙ্গা করবেন। মানুষ চায় এমন একজন নেতাকে, যিনি কেবল ঢাকা থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন না, বরং যার শিকড় থাকবে গ্রামের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। 

তারেক রহমান এমন এক সময় ফিরছেন যখন বাংলাদেশ এক যুগ সন্ধিক্ষণ তথা ইতিহাসের কঠিন বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। বিগত প্রায় দেড় দশকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থর্নীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশেষ করে সকল গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। গত ১১ ডিসেম্বর আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তবে চারদিকের পরিস্থিতি ও ঘটনপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে চতুর্মুখী চক্রান্ত এখনও থেমে নেই। ঠিক যেন এক অস্থির সময়ে দেশে প্রত্যাবর্তন হলো আগামীর রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের। 

বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘদিনের ক্ষত হলো প্রতিহিংসা। এক দল অন্য দলকে নিশ্চিহ্ন করার যে অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সাধারণ মানুষ তা থেকে মুক্তি চায়। তারেক রহমান তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে বারবার ‘রেইনবো নেশন’ বা রংধনু জাতির কথা বলেছেন, যেখানে সব মত ও পথের মানুষের সহাবস্থান থাকবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, তিনি দেশে ফিরে প্রতিহিংসার রাজনীতির কবর দেবেন এবং সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করবেন। পতিত স্বৈরাচার সরকারের ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে চব্বিশোত্তর বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়তে হবে তারেক রহমানকে। তবে এটি খুব সহজ নয়। দেশের সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ মনে করেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে জবাবদিহিতামূলক রাজনীতির সূচনা হবে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে তিনি একটি সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করবেন—এমনটাই সাধারণের প্রত্যাশা। বিশেষ করে যুবসমাজের কাছে তিনি একজন ‘আইকন’, যারা মনে করেন তারেক রহমানের আধুনিক চিন্তা ও প্রযুক্তি-বান্ধব পরিকল্পনা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে এগিয়ে নেবে।

বিদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ বাংলাদেশি তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছেন। প্রবাসীদের প্রত্যাশা—তিনি দেশে ফিরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবেন যেখানে প্রবাসীদের জান-মালের নিরাপত্তা থাকবে এবং দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির অবসান ঘটবে। ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রবাসীদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির ব্যাপারেও তার প্রতি অনেকের জোরালো আশা রয়েছে। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, বিদেশে অবস্থানরত প্রায় দেড় কোটির বাংলাদেশি দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু তারা দীর্ঘকাল ধরে নানাভাবে উপেক্ষিত। প্রবাসীদের প্রত্যাশা, তারেক রহমানের নেতৃত্বে এমন একটি সরকার আসবে যারা প্রবাসীদের সম্মান রক্ষা করবে এবং তাদের পাঠানো অর্থের সুরক্ষা দেবে। প্রবাসীরা চান এয়ারপোর্টে হয়রানি বন্ধ হোক, দেশে তাদের জায়গা-জমির নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক এবং সর্বোপরি তারা যেন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বা সংসদে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অবদান রাখতে পারেন। তারেক রহমান প্রবাসীদের এই সমস্যার কথাগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বারবার তুলে ধরেছেন, যা তাদের মনে এক বড় আশার সঞ্চার করেছে।

তারেক রহমান রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ‘৩১ দফা’ রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। সেখানে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করছে, তিনি দেশে ফিরে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন। প্রতিহিংসার রাজনীতির বদলে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বা ‘জাতীয় ঐক্য’ ভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হবে তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশার জায়গা।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মহল চায় বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা। তারেক রহমান যেভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন, তাতে ধারণা করা হচ্ছে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে ফিরে আসবে। এখানে বলা আবশ্যক যে, তারেক রহমান গত প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় লন্ডনে অবস্থান করে বৈশ্বিক রাজনীতির নাড়ি-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিবিদদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশা, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিদেশনীতি অনুসরণ করবে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেন পারস্পরিক মর্যাদা ও স্বার্থের ভিত্তিতে হয়—এটাই জনগণের আকাঙ্ক্ষা। সেইসঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ও আলোচিত বিষয় সীমান্তে হত্যা বন্ধ এবং তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে তারেক রহমানের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনার জন্য মানুষ মুখিয়ে আছে।

তাছাড়াও যুবসমাজের কর্মসংস্থান, দুর্নীতি দমন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তারেক রহমানের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই যুবক। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আজ বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তারেক রহমান তার বিভিন্ন বক্তব্যে ‘মেরিটোরিয়াস বাংলাদেশ’ বা মেধাবী বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা, তিনি দেশে ফিরে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), ফ্রিল্যান্সিং এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণ-আকাঙ্ক্ষার পেছনে তারেক রহমানের নৈতিক সমর্থন তরুণদের তার প্রতি আরও আস্থাশীল করেছে। তারা চায় মেধার ভিত্তিতে একটি বৈষম্যহীন সমাজ। 

বিগত বছরগুলোতে অর্থপাচার এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, তারেক রহমান দেশে ফিরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করবেন। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনাই হবে তার নেতৃত্বের বড় পরীক্ষা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষকরা প্রত্যাশা করছেন এমন এক পরিবেশ, যেখানে চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট থাকবে না। তারেক রহমান বরাবরই জেন্ডার ইকুয়ালিটি বা লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাসী। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বেশিই নারী। তারা চায় কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ। তারেক রহমানের কাছে নারীদের প্রত্যাশা—তিনি এমন আইন ও কাঠামো তৈরি করবেন যা সহিংসতা মুক্ত এবং নারীবান্ধব বাংলাদেশ নিশ্চিত করবে। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচালনার দাবিও জোরালো।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথায় উপণীত হওয়া যায় যে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেবল ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়; এটি একটি জাতির পুনর্জন্মের ক্ষণ। এটি একটি রাজনৈতিক দর্শনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ সংগ্রামের পর তিনি যখন দেশের মাটিতে পা রাখবেন, তখন তার কাঁধে থাকবে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভার। ফ্যাসিবাদের শত অত্যাচার, নিপীড়ন এবং জেল-জুলুম সহ্য করে তিনি যেভাবে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা তাকে একজন পরিণত জননেতায় রূপান্তরিত করেছে। দেশ ও বিদেশের লাখো মানুষের যে পাহাড়সম প্রত্যাশা তার ওপর অর্পিত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। জনমানুষের এই বিপুল প্রত্যাশাকে তিনি যখন সঠিক নেতৃত্বে রূপান্তর করতে পারবেন, তখনই সার্থক হবে তার এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তবে তারেক রহমানের অদম্য সাহসিকতা এবং জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন থাকলে বাংলাদেশ আবারও বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সবুজ-শ্যামল এই বাংলায় ইনসাফ কায়েম হবে, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ নির্ভয়ে কথা বলতে পারবে—তারেক রহমানের ফিরে আসার মধ্য দিয়েই রচিত হবে সেই আগামীর বাংলাদেশ।

লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।