নিজস্ব প্রতিবেদক
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৩০ পিএম
২০১৩ সালের এক বসন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয়। সেই থেকে আমি তাকে ওসমান নামেই জানতাম। সে ও বুরহান—দীর্ঘ ২৮ বছরের বন্ধুত্বের সাক্ষী। দুজনেরই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ততা আমাকে মুগ্ধ করত। তাই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার অসংখ্য তর্ক–বিতর্ক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই তারা রামপুরায় থাকত। ফলে তাদের আড্ডাস্থল ছিল হাতিরঝিল। সেই আড্ডায় অনেকবার দাওয়াত পেলেও, যতদূর মনে পড়ে, একবারই গিয়েছিলাম।
ওসমান ছিল সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের ইংরেজির এক জনপ্রিয় শিক্ষক। একদিন বুরহানকে বলেছিলাম, “ওসমানকে বলো, কোচিং ছেড়ে চাকরিতে যোগ দিতে।” বুরহান জানায়, ওসমান প্রথাগত চাকরিতে আগ্রহী নয়। অনেক বছর পর, ২০২৩ সালে, যখন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ ও ‘হিস্টোরি অব দ্য ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ’ কোর্সের জন্য চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, তখন বুরহান ওসমানের সিভি দিয়ে বলল, “ওসমানের সিভিটা দেখেন, কিছু করা যায় কি না।” আমরা নিয়ম মেনে শর্টলিস্ট করে ওসমানকে পরীক্ষার জন্য ডেকেছিলাম। কিন্তু সে আর পরীক্ষা দিতে আসেনি। বুরহান জানাল, দ্বিধা–দ্বন্দ্বে ভুগছিল বলে সে আসেনি। আহা! সেদিন যদি সে আসত, তবে সহকর্মী হিসেবে তাকে পাওয়ার সৌভাগ্য হতো আমার।
বাংলা সালতানাত, সুবাহ বাংলা, স্বাধীন বাংলা—এসব বিষয়ে ওসমানের ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। সে স্বপ্ন দেখত এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের, যার মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসবে। সেই লক্ষ্যে জুলাই বিপ্লবের দুই বছর আগে থেকেই, ২০২৩ ও ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে, ওসমান ‘ঈদ মিছিল’ বের করার উদ্যোগ নেয়। আমার পরিচিত কয়েকজন পরিবার–পরিজন নিয়ে তার সেই ঈদ মিছিলে অংশও নিয়েছিলেন।
ওসমান ভালো কবিতা লিখত। তার কবিতা ছিল বহুমাত্রিক—প্রেম, বিরহ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিপ্লব—সবকিছুরই প্রতিচ্ছবি। মাঝেমধ্যে সে আমাকে কবিতা পাঠাত। আমি কবিতার ভাষা কম বুঝি, তাই কখনো তাকে যথাযথ ফিডব্যাক দিতে পারিনি। ২০২৪ সালের বইমেলায় ‘সীমান্ত শরিফ’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় তার প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ লাভায় লালশাক পুবের আকাশ। বইটি নিয়ে তার উচ্ছ্বাস ছিল অদম্য। বলেছিল, “ভাই, মেলায় এলে অবশ্যই আমাদের স্টলে আসবেন।” যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। ওসমানের সেই মানসসন্তান আজও কেনা হয়নি আমার—আফসোস।
২০২৪ সালের জুলাই মাস। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিষ্ঠুর গণহত্যায় বাংলাদেশ তখন এক বিশাল বধ্যভূমি। এই ভয়াবহতার মধ্যেই ২৪–২৫ জুলাইয়ের দিকে একদিন বুরহান আর আমি নানা কথা বলছি—এমন সময় এক অপরিচিত নম্বর থেকে ওসমান বুরহানকে ফোন করে জানাল, রামপুরায় থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ তাকে খুঁজছে। কয়েক দিনের জন্য রাতের আশ্রয়ের ব্যবস্থা দরকার। উল্লেখ্য, চব্বিশের বিপ্লবে রামপুরা–বনশ্রী ব্যাটলফিল্ডে দাঁড়িয়ে যে কজন যুবক সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছে, ওসমান হাদি ছিল তাদের অন্যতম।
অবশেষে জুলাই বিপ্লব সফল হলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেল ভারতে। দেড় হাজার প্রাণের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম এক নতুন স্বাধীনতা। আর এই নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রিয় ওসমান আবার যাত্রা শুরু করলেন তার পুরোনো সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মন্ত্র নিয়ে। তিনি নেমে পড়লেন রাষ্ট্র সংস্কার, কালচারাল ফ্যাসিজম ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে। জন্ম দিলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর। ভারতীয় বাঁধের কারণে ফেনী যখন ডুবল, তখন তার নেতৃত্বে পরিচালিত হলো ঐতিহাসিক ডম্বুর বাঁধ অভিমুখী লংমার্চ। যেন আমরা আবার মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম।
লংমার্চ শেষে ঢাকায় ফিরে আমি ওসমান ও বুরহানকে সতর্ক করে বলেছিলাম, “১৯৭৬ সালে ফারাক্কা লংমার্চের পর মওলানা ভাসানী বেশিদিন বাঁচেননি। ২০১০–১১ সালে টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদ করায় ইলিয়াস আলী গুম হন, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান একাধিকবার হামলার শিকার হন। তোমাদের পথও কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।” ওসমান জানাল, সব ঝুঁকি মাথা পেতে নিয়ে সে ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী ভূমিকা চালিয়ে যেতে চায়। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের প্রত্যয়দীপ্ত ওসমান হাদিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা কেউ কি এ নিয়ে যথাযথভাবে সরব হতে পেরেছি? এই নীরবতা কি আমাদের অপরাধ নয়?
জুলাই বিপ্লবের পর সেই চেনা ওসমান ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠল বিপ্লবী হাদি নামে। ভারতীয় আগ্রাসন, কালচারাল ফ্যাসিজম ও মুজিববাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে হয়ে উঠল প্রতিরোধের এক অনন্য প্রতীক। গত এক বছরে জুলাই বিপ্লবের মূল স্পিরিট নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাঠে ছিল ওসমান হাদীর ইনকিলাব মঞ্চ। মাঝে মাঝে তাদের অতিউদ্যম ভুল পথে যেতে পারে ভেবে আমি হস্তক্ষেপ করেছি। কারও দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার সামান্য আশঙ্কা দেখা দিলে, কেবল আমার কথায় তারা কর্মসূচি স্থগিত করেছে, কর্মসূচির ধরন বদলেছে, এমনকি ফেসবুক পোস্টও মুছে দিয়েছে। আমার প্রতি ওসমান ও বুরহানের এই বিশ্বাস ছিল যে, আমি যা বলেছি, তা তাদের ভালোর জন্যই বলেছি।
ওসমান হাদির সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল অক্টোবরের শুরুর দিকে। শাহবাগে সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার পর সে বলল, “ভাই, আপনাকে খুঁজছি। এখানে কথা বলা নিরাপদ নয়, চলুন ক্যাম্পাসে যাই।” এরপর সে জানাল—নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তাকে বলা হয়েছে, তিনজন জুলাই বিপ্লবীকে টার্গেট কিলিংয়ের জন্য বিদেশে লেনদেন হয়েছে, যার একজন সে নিজেই। কী করণীয় জানতে চাইলে আমি তাকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে বলি। একই সঙ্গে বিষয়টি জনপরিসরে আনা, সরকারের সর্বোচ্চ মহলে জানানো, দ্রুতগতির যানবাহন ব্যবহার এবং নিজস্ব একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরির পরামর্শ দিই। আফসোস, সব জানার পরও আমরা বিপ্লবী হাদিকে রক্ষা করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এর চেয়ে বড় আফসোস আমার জীবনে আর কী হতে পারে!
নিরাপত্তা সংকট নিয়ে কিছুদিন সতর্ক থাকলেও ঢাকা–৮ আসনের নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে সে যেন সব ভুলে গেল। নভেম্বরের শুরুতে ফোন করে বলল, “ভাই, জানি অনেক প্রশ্ন করবেন… তবে আমি, হাসনাত আর ফুয়াদ ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচন করব। ৫০০ ভোট পেলেও খুশি, কম পেলে একটু খারাপ লাগবে… দোয়া করবেন, আর আপনার পরামর্শ চাই।” এই প্রচারণায় আমাদের প্রিয় ওসমান যেন হয়ে উঠলেন আরেক মওলানা ভাসানী। মানুষের এত ভালোবাসা ও আবেগ আমি আগে কখনো দেখিনি।
অবশেষে ওসমান হাদির আশঙ্কা ও আকাঙ্ক্ষা—দুটোই সত্য হলো। ঘাতকের বুলেটে শহীদ হয়ে গেল আমার এক যুগ আগের সেই ওসমান, আমাদের সাচ্চা বিপ্লবী ওসমান হাদি। আমাদের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটির পতন হলো। তার অসংখ্য বক্তব্যে শহীদ হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মহান আল্লাহ সেটিই কবুল করেছেন। শহীদ হয়ে অমর হয়ে গেলেন প্রিয় বীর বিপ্লবী শহীদ ওসমান হাদি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শহীদ জিয়াউর রহমান ও শহীদ শরীফ ওসমান হাদির মতো বীরোচিত বিদায় আর কেউ পেয়েছে কি না, কিংবা ভবিষ্যতে আবার কবে পাবে—তা আমাদের অজানা। তবে শহীদ ওসমান হাদি আমাদের ওপর, বাংলাদেশপন্থীদের ওপর, এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। বাঙালি মুসলমানকে তিনি চিরঋণী করে গেছেন। ইনসাফের নতুন সূর্য উদিত করতে আমাদের সবার উচিত তার প্রতিষ্ঠিত ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ও ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’-কে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। মহান আল্লাহ সহায় হোন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক