২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২২ পিএম
হযরত বাহাউদ্দীন নাখশবন্দী একদিন তার অনুগামীদের নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। সেই সময় একটি পাখি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। আর বেরুতে পারছে না। একবার এই দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে তো আরেকবার ওই দেয়ালে। পাখিটাকে সাহায্য করার জন্যে যখন একজন অনুগামী উঠতে যাবেন, তখনই হযরত বাহাউদ্দীন তাকে বারণ করলেন। এরপর পাখিটা ছটফট করতে করতে একসময় ঘরের একপাশে দেয়ালের এক কোনে গিয়ে বসে বসে হাঁপাচ্ছিল। কিছুটা শান্ত হতেই হযরত একটা হাততালি দিলেন। চমকে উঠল পাখিটা, তাকালো এদিক সেদিক। বেরোনোর পথ দেখে নিল। উড়ে সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হযরত বাহাউদ্দীন বললেন, ‘দেখো, পাখিটা যখন ছটফট করছিল, ওড়াওড়ি করছিল তখন তুমি যত কিছু বোঝাতে চাও না কেন সে বুঝত না। বরং যখন সে শান্ত হলো, নীরব হলো, তখন হাততালির শব্দে সে চমকে উঠল ঠিকই; কিন্তু নতুন সত্য উপলব্ধি করে সহজে সঠিক পথটি পেয়ে গেল। সে মুক্তি পেল। অর্থাৎ কেবল প্রশান্ত থাকতে পারলেই মুক্তির সঠিক পথ মেলে।
স্রষ্টা মানুষকে জীবন দিয়েছেন। জীবনের আনন্দসহ অনেক কিছুই দান করেছেন। স্রষ্টার এসব দান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কোথায় ছড়িয়ে আছে তা চোখ মেলে দেখতে হয়, কান পেতে শুনতে হয়। এরপর সংগ্রহ এবং সেগুলোকে জীবনের কাজে ব্যবহার করতে হয়। এ কাজটি সবচেয়ে ভালো পারেন যিনি নিজের মধ্যে স্থিরতা বজায় রাখতে পারেন, প্রশান্ত থাকতে পারেন। কেননা আত্মনিমগ্ন হলেই তিনি শুনতে পান, দেখতে পান এবং সময়মতো তা কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনে সুখ সৃষ্টি করতে পারেন। আর যিনি অস্থির চিত্ত, যিনি অশান্ত তিনি সবকিছুর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, নানাভাবে জীবনকে তিনি করে তোলেন অসুখী। অর্থাৎ একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির না হচ্ছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আত্মনিমগ্ন না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যথার্থ জ্ঞানী যথার্থ সুখী হতে পারেন না। যিনি প্রশান্ত তিনি জীবনকে, জীবনের সমস্যাকে, জীবনের সংকটকে কাটিয়ে ওঠেন আস্থার সাথে, কুশলতার সাথে। এখানেই মেডিটেশন বা ধ্যানের গুরুত্ব।
মেডিটেশনের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে সাম্প্রতিক ২০১৮ সালের জুন মাসের দিকে তাকানো যায়। প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ধ্যানের মাধ্যমে কীভাবে প্রশান্ত থাকা যায়; থাইল্যান্ডের গুহার ঘটনায় তারই প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববাসী। একাপল চ্যান্থাওং থাইল্যান্ডে এক পাহাড়ের গুহায় ১২ জন কিশোর ফুটবলারসহ আটকে পড়েন আড়াই সপ্তাহের বেশি। তিনি ছিলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, পরবর্তীতে হন ফুটবল কোচ। আটকে পড়া অন্ধকার গুহায় কিশোরদের শুধু খেয়াল রাখাই নয়, মনোবল ধরে রাখার জন্যে তিনি কিশোরদের ধ্যানচর্চা করিয়েছেন। আশাবাদে উদ্বুদ্ধ করে রেখেছেন। সমমর্মিতার অনন্য উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন তিনি। কিশোরদের বাঁচাতে একাপল নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। নিজে না খেয়ে সঙ্গে থাকা খাবার সবাইকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভাগ করে দিয়েছেন। পাহাড়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়া পানি পান করেছেন। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এসব এখন কারো অজানা নয়।
আসলে জীবন যতদিন আছে সমস্যা থাকবেই। কিন্তু মনে প্রশান্তি থাকলে, মাথা ঠান্ডা থাকলে প্রতিটি পরিস্থিতি আস্থার সাথে, সাহসের সাথে, কুশলতার সাথে মোকাবেলা করা যাবে। মুক্তির পথ পাওয়া যাবে। কারণ অস্থিরতা আমাদেরকে বন্দি করে কিন্তু প্রশান্তি মুক্তির ডানা মেলে উড়তে সাহায্য করে। আর প্রশান্তির প্রথম ধাপই হচ্ছে মেডিটেশন। একজন ধ্যানী যখন প্রশান্ত থাকেন তখন তিনি যেকোনো সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পান। কোনো ক্ষত ছাড়াই সেখান থেকে বের হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনের পথে হাঁটতে পারেন।
মেডিটেশনের বিকাশ এবং উদ্ভব হয়েছে এই বাংলায়। মহামতি বুদ্ধ এই ধ্যানকে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়েছেন। এই ধ্যান বাংলা থেকে চীনে গেল। চীন থেকে জাপানে। এখন পুরো ইউরোপ আমেরিকাতে নানা নামে ধ্যান এখন বিশ্বস্বীকৃত প্রশান্তির অন্যতম একক। আমাদের দেশেও মেডিটেশন এখন ঘরে ঘরে। সহজ প্রক্রিয়ার কোয়ান্টাম মেথড পদ্ধতির উদ্ভাবক একজন বাঙালি। তিনি শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। এর চেতনা গড়ে উঠেছে শুকরিয়াকে কেন্দ্র করেই। যিনি মেডিটেশন বা ধ্যানচর্চায় নিয়মিত তিনি আসলে শোকরগোজার হন। প্রশান্তি অনুভব করেন। এজন্যেই একজন ধ্যানীর জীবনে ব্যস্ততা আছে কিন্তু হুলস্থূল নেই; সমস্যা আছে কিন্তু সংকট নেই। রয়েছে সমাধানের সহজ পথ। অশান্তি নেই, রয়েছে প্রশান্ত প্রত্যয়। তিনি অবগাহন করেন প্রশান্তির ঝর্নাধারায়।
ধ্যান বা মেডিটেশন প্রথমত দেহের স্নায়ু ও পেশিকে শিথিল করে। দেহ ও মন যখন স্থির হয়, তখন রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-হিংসার মতো নেতিবাচক আবেগ কাজ করতে পারে না। এ ধরনের আবেগ এলে সাধারণত আমরা শান্ত থাকতে পারি না। আমরা ভুল করি। যেমন, আমরা যখন রেগে গিয়ে যে কাজটা করি সেটির জন্যে পরে আবার নিজে অনুশোচনা করি- আহা কাজটা তো ঠিক হলো না! তারপর সরি বলি, মাফ চাই। এর মানেটা কী? মনের নেতিবাচক আবেগ আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। কিন্তু যখন নিয়মিত মেডিটেশন নিয়মিত করি, তখন আমরা এই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
মেডিটেশন মূলত আমাদের মনকে বর্তমানে নিয়ে আসে। কারণ মন যদি অতীতে থাকে বা মন যদি ভবিষ্যতে থাকে, তাহলে অশান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ অতীতে ভালো ঘটনা মনে করার চেয়ে আমরা দুঃসহ স্মৃতিকেই প্রথমে মনে করতে থাকি। ফলে আমাদের মনে ক্ষয়ানুরণন সৃষ্টি হয়। আবার যখন ভবিষ্যতে মন থাকে, তখন প্রত্যাশার চেয়ে সাধারণত আশঙ্কাটাই মনে বেশি জানান দেয়। কাল্পনিক বিপদ মনের পর্দায় ভাসতে থাকে। মেডিটেশন যেহেতু মনকে বর্তমানে থাকতে সাহায্য করে, তাই অনুশোচনা, দুঃখ কিংবা আশঙ্কার কল্পনা কোনোটাই পাত্তা পায় না। মন তখন ব্যস্ত থাকতে পারে দেহের স্বাস্থ্য উদ্ধারে, সম্ভাব্য সংকট নিরসন ও মেধার বিকাশে।
মেডিটেশন হচ্ছে ব্রেনের কুলিং সিস্টেম আর মাইন্ডের ক্লিনিং সিস্টেম। কুলিং সিস্টেমকে ঠিক রাখার জন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশন। এর মাধ্যমে ব্রেনটাকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা যায়। এজন্যেই দিনে দুই বেলা মেডিটেশন করা প্রয়োজন। দু’বার যদি করতে না পারা যায় তাহলে দিনে অন্তত একবার হলেও মেডিটেশন শুরু করা যায়। আর দিনের শুরুতে করলে মাথাটা ঠান্ডা থাকবে। সারাদিনের জন্যে মনটা থাকবে স্থির। ২১ ডিসেম্বর বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। সবাইকে দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজকর্মী