০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৩০ পিএম
চিকিৎসক মানেই অসুস্থ মানুষের আস্থার প্রতীক। এদেশে অনেক মানবিক হৃদয়বান চিকিৎসক রয়েছেন। তাদেরই মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আছেন তিনি। অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
ডা. জাকির একজন সক্রিয় চিন্তার মানুষ। এই মানুষটির কাছে মানবিকতা তাই বেশি গুরুত্ব পায়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রংপুর জেলার জনমানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণামূলক কার্যক্রমে যুক্তকরণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা পরিচালনার জন্য ২০০৮ সালে ডা. ওয়াছিম-ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানেরই আওতায় দেশবিখ্যাত হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, রংপুর যা ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অধ্যাপক ডা. জাকির এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আধুনিক প্রযু্ক্তিসম্পন্ন ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে কমিউনিটি লেভেলে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদানে তাঁর হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ভূমিকা অনন্য।
এই প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার, নার্স, প্যাথলজি, রেডিওলজি, ও ইমেজিংসহ অন্যান্য ইউনিটের দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং টেকনিশিয়ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি রংপুরে হলেও সারাদেশের মানুষকে সেবা দিচ্ছে। সারাদেশে সচেতনতামূলক সেমিনার, উঠান বৈঠক, মেডিকেল ক্যাম্প, এনসিডি ক্যাম্প এবং ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলায় এ সেন্টারের অংশগ্রহণের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। এই প্রতিষ্ঠানে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ডাটা সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যশিক্ষাবিষয়ক একাডেমিক প্রশিক্ষণ কোর্স [সার্টিফিকেট কোর্স অন হাইপারটেনশন (সিসিএইচ), সার্টিফিকেট কোর্স অন রিসার্চ ম্যাথডোলজি অ্যান্ড বেসিক বায়োস্ট্যাটিসটিকস (সিসিআরএমবিবি) ও গবেষণা] পরিচালন করছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রদানে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। যাদের উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস আছে তারা মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করে এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারেন এবং পরবর্তীকালে আজীবন ৪০ টাকা প্রদান করে ফলোআপ করতে পারেন। অধ্যাপক ডা. জাকির এ প্রতিষ্ঠানে ১৮ বছর যাবৎ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন। ৯.১২.২০২৫ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৯৫ হাজার রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন এবং ৫৪,২২৬ জন নিবন্ধনকৃত রোগী নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে নিবন্ধিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় গরিব ও প্রতিবন্ধিদের বিনামূল্যে চিকিৎমাসেবা প্রদান করা হয়।
অধ্যাপক ডা. জাকির তাঁর জন্মস্থান বগুড়ার ধুনটের গোসাইবাড়ীতে ১৯৩৮ সালে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত ইউসুফিয়া মেডিকেল হল যা বর্তমানে তিনি তার পিতামাতার নামে ডা. ওয়াছিম-ওয়ালেদা চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানে ২০০৫ সাল থেকে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট দিনে বিনামূল্যে রোগী দেখেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে দরিদ্রদের আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করে থাকেন।
অধ্যাপক ডা. জাকির গোসাইবাড়ীতে নিজ নামে একটি সমৃদ্ধ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন। এই গ্রন্থাগার বাংলাদেশ সরকারের ‘ক’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত। গ্রন্থাগারে অভিধান-বিশ্বকোষ, ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র-নজরুলসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় ৫০টি শাখার ওপর ৮,০০০ টি বই রয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগসহ বইপত্র ডিজিটাইজেশন পদ্ধতিতে এন্ট্রিকরণ এবং গ্রন্থাগারের যাবতীয় কার্যক্রম সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই এলাকায় পাঠাভ্যাস এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গ্রন্থাগারটি ব্যাপক অবদান রাখছে।
অধ্যাপক ডা. জাকির তাঁর পিতামাতার নামে প্রতিষ্ঠিত ডা. ওয়াছিম-ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ফান্ড থেকে ২০০৫ সাল হতে ধুনটের স্থানীয় দুটি স্কুলে গোসাইবাড়ী এ এ উচ্চ বিদ্যালয় এবং তাঁর পিতার দানকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত গোসাইবাড়ী করিম বক্স ওয়াছিম উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত বৃত্তি, পোশাক ও জুতা- মোজা প্রদান করে।
এছাড়াও তিনি ২০১৪ সাল থেকে অদ্যাবধি রংপুরে সিনিয়র সিটিজেন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের সভাপতির কার্যভার পালন করে আসছেন। ধুনটের ভান্ডারবাড়ীতে তার দানকৃত জমিতে সরকারের গৃহহীন আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় বিরাট গুচ্ছগ্রাম গড়ে উঠেছে। ধুনটের শিমুলবাড়ী গ্রামে তার দানকৃত জমিতে অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ অঞ্চলে এ ক্লিনিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। শিমুলবাড়ীতে তাঁর দানকৃত জমিতে তিনি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দনভাবে মসজিদ, ঈদগাঁ মাঠ, কবরস্থান নির্মাণ করেছেন।
অধ্যাপক ডা. জাকির ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রংপুর অটিস্টিক ওয়েলফেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন।
অধ্যাপক ডা. জাকিরের বাংলা একাডেমির সাম্মানিক ফেলোশিপ প্রাপ্তি একটি বিশেষ স্বীকৃতি। ফেলোশিপ প্রাপ্তির অনেক আগে থেকেই তিনি বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে স্বাস্থসেবা প্রদান করে আসছেন। তাঁর একটি বিশেষ গুণ, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কেউ অসুস্থ হলে তিনি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি বগুড়ায় বাস করেন। কিন্তু দেশজুড়ে ডক্টর কমিউনিটিজ নেটওয়ার্কের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বাংলা একাডেমির কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা চাইলে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ইতোমধ্যে অনেকেই তাঁর রেফারেন্সে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হয়েছেন। তিনি শুধু নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নয় বরং যে কেউ তাঁর কাছে এলে বা চিকিৎসাসেবা চাইলে দরদি অন্তঃপ্রাণ নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন।
অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন নিরলসভাবে রোগীকে চিকিৎসা দেন, মানসিক ভরসাও দেন। আমরা মনে করি এই মহান চিকিৎসককে রাষ্ট্র তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করুক। তাঁকে জাতীয় পুরস্কার বা পদকে ভূষিত করুক এই দাবি রাখছি। প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন ১৯৬১ সালের ১০ই ডিসেম্বর বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মদিনে তাকে নিরন্তর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক; কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি।