images

মতামত

ফ্যাক্টচেক: তারেক রহমানকে নিয়ে যেসব গুজব সত্য নয়

০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৫ পিএম

তারেক রহমান ব্রিটিশ নাগরিক - সত্য নয়। তারেক রহমান গোপনে বাংলাদেশে রওয়ানা হচ্ছেন- সত্য নয়। মায়ের কাছে না ফিরে ভুল করছেন তারেক রহমান: সত্য নয়। তারেক রহমান কোম্পানী হাউজে ব্রিটিশ নাগরিক উল্লখ করা - সত্য নয়। 

সঠিক তথ্য হলো— গত সপ্তাহ ধরে তারেক রহমান বিশ্বের সব নামকরা ডাক্তারদের দ্বারে দ্বারে নক করেছেন, কিভাবে প্রিয় মা বেগম খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। বারবার বাংলাদেশের চিকিৎসক টিমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনলাইনে যুক্ত করেছেন এবং পরামর্শ করে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।

তারেক রহমান কেন দেশে ফিরছেন না? প্রিয় মায়ের কাছে দ্রুত যাওয়ার সাহসটুকু কেন তাঁর নেই? তারেক রহমান গোপনে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করছেন - এমন হাজারো গুজব যখন চলছিল, তখন তারেক রহমান চিকিৎসকদের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন, প্রিয় মাকে কিভাবে লন্ডনে কিংবা বিশ্বের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে সরাসরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। তিনি চীন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসকদের ঢাকায় নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

তারেক রহমান অবশ্যই এক সপ্তাহ আগেই ফ্লাইটে চড়ে মায়ের কাছে ফিরতে পারতেন, কিন্তু তিনি মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। কাতারের আমিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছেন। এখন সব কিছু ঠিক থাকলে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের চিকিৎসক টিমসহ আগামীকাল ফ্লাই করতে পারবেন,  ইনশাল্লাহ।
 
তার মানে হলো - আমরা সবাই যখন গুজবের হাইপ তুলেছিলাম, তখন তারেক রহমান সঠিক কাজটিই করার চেষ্টা করেছেন। প্রিয় মায়ের চিকিৎসাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং আল্লাহ চাইলে বেগম খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসা সম্ভব হলে তিনি ভালো হয়ে উঠবেন বলে দেশবাসী প্রত্যাশা করছেন। 

কিন্তু, তারেক রহমান যদি বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা শুনেই দেশে ফিরতেন, তখন কি তারেক রহমান এখন দেশে থেকে যেতেন, নাকি মায়ের সঙ্গে আবার লন্ডনে ফিরতেন? দেশে থেকে গেলে অতিউৎসাহী গোষ্ঠী বলতো, তিনি মায়ের সঙ্গে কেন গেলেন না; আর চলে আসলে বলতো, তিনি নির্বাচনের জন্য কেন থাকলেন না?

factcheck_bnp_mahabubur_rahman_ii
তারেক রহমানের সঙ্গে স্ত্রী (বাঁয়ে) ও কন্যা (ফাইল ছবি)

 

সুতরাং তারেক রহমানকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, মায়ের সুস্থতা ও দেশের স্থিতির স্বার্থে। তিনি একই সঙ্গে সন্তানের দায়িত্ববোধে নিবেদিত, আবার জাতীয় নেতার দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ।

মনে রাখা প্রয়োজন, তারেক রহমানের কাছে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া প্রথমে মা, তারপর নেত্রী। মায়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সঙ্গে আমাদের কারো ভালোবাসার তুলনা করা অন‍্যায়, অবিচার। তিনি তাঁর মায়ের জন‍্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটিই করছেন, সেটিই করে যাবেন। এরপরও প্রশ্ন থাকে - কবে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান?

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও চলছে নানা গুজব। মিথ্যা অপপ্রচারের ঢালি সাজিয়ে বসেছেন অনেকে। অনেকে বলছেন, যুক্তরাজ্যে তার রেসিডেন্সির অবস্থার কারনে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না! আবার বলেছন, তিনি ব্রিটিশ নাগরিক সেজন্য ফিরছেন না! বৃটেনের কোম্পানী হাউজের একটি তথ্য ফটো এডিট করে তারেক রহমানকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করার চেষ্টা করছেন তারা। ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশি পত্রিকার একজন সম্পাদক আমাকে এ বিষয়টি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। বললেন, কোম্পানী হাউজে তারেক রহমানকে যেহেতু ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেছে, সেহেতু তিনি ব্রিটিশ। আর এটি কোনো সমস্যা হতে পারে তার দেশে ফেরার! আমি হাসলাম, তাকে কোম্পানী হাউজের সঠিক লিঙ্কটি পাঠালাম এবং বললাম, আমি একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার এবং সলিসিটর। আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি - এসব গুজব। আপনি ওয়েব লিঙ্কটি ওপেন করে দেখতে পারেন। https://find-and-update.company-information.service.gov.uk/company/09665750/officers  

পরে ওই সম্পাদক বিষয়টি গুজব বলে মানলেন। এরপরও তিনি আমাকে বুঝাতে চাইলেন - তারেক রহমান ব্রিটিশ ট্রাভেল পাস নিয়ে চলাফেরা করেন। আর এজন্যই হয়তো তাঁর দেশে ফিরতে সমস্যা থাকতে পারে। 

ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন আইনের বিশ্লেষণে তাকে জানালাম, কেউ এই দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে তিনি ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে বিদেশ সফর করতে পারেন, শুধুমাত্র নিজের দেশ ছাড়া। পাঁচ বছর পরে সেটেলমেন্ট বা স্থায়ী বাসিন্দার অনুমতি পেলে আরও এক বছর অপেক্ষার পর তিনি ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ নিতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী তারেক রহমান সেটেলমেন্ট নিয়েছেন- এটি একশতভাগ সত্য। এরপর তিনি ব্রিটিশ সিটিজেনশীপ হয়তো নেননি এবং ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে তিনি বিদেশ সফর করছেন। কিন্তু নিজের দেশে ফিরতে হলে তাকে অবশ্যই বাংলাদেশী পাসপোর্ট কিংবা ট্রাভেল পাস নিতে হবে। এই ট্রাভেল পাস কিংবা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিলে তাতে তারেক রহমানের সেটেলমেন্ট স্ট্যাটাসের কোনো ক্ষতি হয় না। এমনকি তিনি বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে ফিরলেও তাঁর স্থায়ী বাসিন্দা কিংবা সেটেলমেন্ট স্যাটাসের কোনো সমস্যা হবে না।

তবে তিনি যখন আবার যুক্তরাজ্যে ফিরবেন, তখন ইমিগ্রেশনে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তাঁর স্থায়ী বসবাসের অনুমতি কার্টেল বা রিভিউ হতে পারে। তারপরও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি সবসময় হতে হয় না। অনেক সময় সেটেলমেন্ট স্ট্যাটাস নিয়ে রিফিউজিরা বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে নিজের দেশ ঘুরছেন এবং বছরের পর বছর কোনো সমস্যা হয় না। তবে পরবর্তীতে ব্রিটিশ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তখন পুরো ভ্রমণ ইতিহাস পর্যালোচনা করে (নিজের দেশে ভ্রমনের রেকর্ড থাকায়) তার রিফিউজি স্টাটাস বাতিল করা হতে পারে। আমি ইরান এবং টার্কির নাগরিক এমন কয়েকজন ক্লায়েন্টকে আইনী সহায়তা দিয়েছি এবং তারা সবাই তাদের রিফিউজি স্ট্যাটাস আবার ফিরে পেয়েছেন। তবে আইনী চ্যালেঞ্জ প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল।

তাহলে বিষযটি হলো- তারেক রহমান যে কোনো সময় বাংলাদেশী পাসপোর্ট কিংবা বাংলাদেশী ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরতে পারছেন। আমার বেশ ক'জন ক্লায়েন্ট এমন ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে অনেকের ইউকে-তে কোনো ভিসা-ই ছিল না। বিষয়টি হলো - ইউকে থেকে আপনি বের হয়ে যেতে চাইলে আপনাকে এদেশের সরকারকে কিছুই জানাতে হবে না। কেবল নিজের দেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিমানের টিকেট কেটে নিজেই চলে যেতে পারছেন। আর তারেক রহমান নিজের রাজনৈতিক অবস্থান, দলের কৌশল ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে কোনো সময় দেশে ফিরতে পারছেন।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে এখন মা বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডনে পৌঁছা এবং পরবর্তীতে তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নিতর ওপর যেমনটা নির্ভর করবে, তেমনি বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দল হিসেবে বিএনপির কৌশল, প্রস্তুতি এবং এতে তারেক রহমানের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে।

আসুন, আমরা গুজব পরিহার করি। সত্যকে উপলব্ধি করি। কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে শুধু নিজের অবস্থান নয়, যাকে নিয়ে সমালোচনা করছি, তার অবস্থানকেও বিবেচনা করতে পারলে সমাজে অহেতুক বিতর্ক কমবে। প্রয়োজনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সুযোগ বাড়বে। বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করছি। সবাই দোয়া করবেন, গণতন্ত্রের সাহসী এই লড়াকু যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। খালেদা জিয়াকে আরো ক'টি বছর বাংলাদেশের খুব দরকার।

লেখক: ব্যারিস্টার, সলিসিটর ও সাংবাদিক