০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:২৯ পিএম
বিজ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতির উন্নয়ন আজ আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বাস্তবতাকে বাস্তবায়নের জন্য জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে স্টিম (STEM) শিক্ষার বিকল্প নাই। স্টিম শিক্ষার বিস্তার মানেই একটি প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ।
বিজ্ঞান (Science) শেখায় প্রকৃতির নিয়ম, আবিষ্কারের উৎস ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি। করোনা মহামারিতে টিকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যন্ত, সবকিছুই বিজ্ঞানের অবদান।
প্রযুক্তি (Technology) আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করেছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, মেশিন লার্নিং, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সবই এর বাস্তব প্রয়োগ। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েল হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে থেকে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস-এর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল হোসেইন সালামির বিল্ডিংয়ের ঘরে পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম হয়। অপরদিকে, ইরানও প্রতিশোধমূলক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ঘাঁটিসহ সুনির্দিষ্ট বস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়।
প্রকৌশল (Engineering) নানা সমস্যার বাস্তব সমাধান তৈরি করে। সড়ক, সেতু, ভবন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে শুরু করে রোবটিকস, এয়ারক্রাফট ডিজাইন পর্যন্ত সবই ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৃতিত্ব। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আমাদের নির্মাণশৈলী, স্থাপত্যগত পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা প্রকৌশলের ভয়াবহ ঘাটতির করুণ উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি ইঞ্চিতে প্রকৌশল জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ না হলে তা হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুর ফাঁদ।
গণিত (Mathematics) STEM-এর ভিত্তি। অঙ্ক ছাড়া কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ডিজাইন বা প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যাংকিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে মোবাইল অ্যাপস, সবকিছুতেই গণিত অপরিহার্য। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সড়ক দুর্ঘটনার হার বিশ্লেষণ, শিক্ষার ফলাফলগত ব্যর্থতা বা বাজেট ঘাটতি বিশ্লেষণেও গণিত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
স্টিম শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো বিশ্লেষণক্ষম, সমস্যা সমাধানে দক্ষ, উদ্ভাবনে সক্ষম একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা। এটি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বইয়ের মুখস্থ বিদ্যার চেয়ে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
স্টিম শিক্ষাই হলো আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকার মূল হাতিয়ার। এটি কেবল শিক্ষার চারটি শাখা নয়, বরং একটি সমন্বিত দক্ষতাভিত্তিক দর্শন, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবনী দক্ষতা অর্জন করে। আজকের বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, কৃষি প্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সবকিছুর পেছনে স্টিমেরই অবদান।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের শতকরা প্রায় ৪০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। অথচ এখনও এই খাতটি অনেকাংশেই প্রথাগত, শ্রমনির্ভর ও অনিরাপদ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (GDP) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১২-১৪ শতাংশ।উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লে একদিকে যেমন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে রফতানি বৃদ্ধি পেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বাড়বে, যা সরাসরি জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। স্টিমভিত্তিক কৃষির বিকাশ কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটাবে, যেমন: এগ্রো-প্রসেসিং, কোল্ড স্টোরেজ, কৃষিপণ্য পরিবহন, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এই দেশের যুবকেরাই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যদি তারা উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে। স্টিম শিক্ষাই পারে জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করতে। আমার মতে, “যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা স্টিম শিক্ষা গ্রহণে পারদর্শী হয়ে ওঠে, তবে বাংলাদেশও প্রযুক্তিগত যুদ্ধজয়ী উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।”
আধুনিক বিশ্বের যে সমস্ত দেশ জ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই প্রাথমিক লেভেল থেকেই স্টিম শিক্ষার প্রতি অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, স্টিম শিক্ষা শুধু চারটি আলাদা বিষয়ের সমষ্টি নয়, বরং এটি বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব গঠনের এক পূর্ণাঙ্গ কাঠামো।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রফেশনালদের জন্য বেশকিছু বই লিখেছি। যেমন: স্টিম অলিম্পিয়াড, এক নজরে বেসিক সায়েন্স, এক নজরে বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এক নজরে বেসিক ম্যাথমেটিক্স। বইগুলোর বৈশিষ্ট্যসমূহ—
১. সম্ভাব্য সকল মৌলিক জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে।
২. বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৩. সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা এবং একটি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে।
৪. আধুনিক তথ্যসমূহে সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
৫. প্রতিটি বিষয়ের সংজ্ঞার সাথে একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
৬. প্রয়োজনীয় চিত্র প্রদান করা হয়েছে।
৭. বাস্তব জীবনের উদাহরণ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
৮. সকল স্তরের সাথে সংযোগ গভীরভাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
৯. উন্নত গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সূত্র বা ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।
১০. উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের পথ দেখানো হয়েছে।
আমি সকল স্তরের জন্য স্টিমকে সাতটি জগতে ভাগ করেছি। জগতসমূহ নিম্নরূপ –
১. হিস্টরি অব স্টিম (History of STEM)
২. অ্যাপ্লিকেশন অব স্টিম (Application of STEM)
৩. বিউটি অব স্টিম (Beauty of STEM)
৪. এনজয়মেন্ট অব স্টিম (Enjoyment of STEM)
৫. স্টিম ফোবিয়া (STEM Phobia)
৬. টিচিং ইন স্টিম (Teaching in STEM)
৭. রিসার্চ অব স্টিম (Research of STEM)
স্কুলভিত্তিক স্টিম ল্যাব স্থাপন, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি এবং ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্টিম শিক্ষাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্টিম শিক্ষাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত শিক্ষায় ভয় দূর করতে সহজ ভাষায় বই রচনা করতে হবে, ইতোমধ্যে এ সম্পর্কিত আমার বহু লেখা রয়েছে। স্থানীয় ভাষায়ও স্টিম সম্পর্কিত বই লিখতে হবে, এ নিয়ে আমার বিস্তর গবেষণা রয়েছে।
আমার গবেষণায় উঠে এসেছে—
১. উপযুক্ত উপস্থাপনা
২. ব্যাখ্যমূলক পদ্ধতি
৩. নিয়মিত অনুশীলন
৪. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো স্টিম শিক্ষা ও গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: নাসা, সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি বিপ্লব STEM ভিত্তিক।
কানাডা ও ইউরোপ: পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, হেলথটেক ও এডুকেশন টেকনোলজি।
জাপান ও চীন: রোবটিক্স, এআই, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিপ্লব।
রাশিয়া ও ইরান: সামরিক প্রযুক্তি, পারমাণবিক গবেষণা, ওষুধ শিল্প।
এসব দেশ তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত ও বিজ্ঞানের সাথে বাস্তব অনুশীলন যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের জন্য এ থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য STEM কোথায় ভূমিকা রাখবে?
১. প্রতিরক্ষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা।
২. শিক্ষা: ভার্চুয়াল ল্যাব, স্মার্ট ক্লাসরুম।
৩. চিকিৎসা: টেলিমেডিসিন, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং।
৪. কৃষি: ড্রোন, সেন্সর প্রযুক্তি ও স্মার্ট কৃষি।
৫. শিল্প ও উৎপাদন: রোবোটিক্স ও অটোমেশন।
৬. সড়ক ও সেতু নির্মাণ: GPS, সেফটি সেন্সর, বেটার ডিজাইন সফটওয়্যার।
৭. নদী ভাঙন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ: GIS ও উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ, ড্রেজিং প্রযুক্তি।
৮. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ: ব্লকচেইন ও ডেটা ট্র্যাকিং প্রযুক্তি।
সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ, স্টিম কি পারে সমাধান দিতে? অবশ্যই পারে। সড়ক দুর্ঘটনা স্টিমের প্রয়োগের মাধ্যমে কমানো সম্ভব। যেমন স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, AI-বেসড দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা চিহ্নিতকরণ, রাস্তায় এমবেডেড সেন্সর প্রযুক্তি, সড়ক নির্মাণে অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করে।
নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান
বেসরকারি ও সরকারি উভয় স্তর থেকে যদি আমার সময়োপযোগী গবেষণাকে আমলে নেওয়া হয়, তাহলে স্টিম শিক্ষায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত, পূর্ববর্তী সময়ে এই ধরনের মূল্যবান গবেষণা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে সেই ভুল শোধরানোর।
পরিশেষে, স্টিম শিক্ষা শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যেই নয়, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীসহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিতে হলে স্টিম শিক্ষা থাকতে হবে জাতীয় অগ্রাধিকারের শীর্ষে। এখনই সময় নতুনভাবে ভাবার, স্টিমকে শিক্ষার মূলধারায় এনে প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার। জ্ঞানই শক্তি, আর সেই জ্ঞানের ভিত্তি হলো স্টিম।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।