২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
কফি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পণ্যগুলির মধ্যে একটি। বৈশ্বিক বাণিজ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির পরেই কফির স্থান। বাংলাদেশে কফির বর্তমান বাজার প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। দেশে প্রতি বছর ৫% হারে কফির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে হিসেবে আগামী পাচ বছরে দেশে কফির বাজার প্রায় ১০০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। বর্তমানে দেশে ২০০০ হেক্টর জমিতে কফি আবাদ হয় এবং তা থেকে প্রায় ৮০ টন কফিবিন পাওয়া যায় , যা মোট চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে কফি পানকারী মানুষের সংখ্যা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিপূর্বে পানীয় চাহিদার দিক থেকে শীর্ষে ছিল সাধারণ পানি ও চায়ের অবস্থান। এখন সে স্থান দখল করছে কফি। শুধু পানেই সীমাবদ্ধ নয়, শিল্পের কাচামাল হিসেবে কফির চাহিদা রয়েছে। ওষুধ, প্রসাধনী ও পানীয় শিল্পের অতি প্রয়োজনীয় ক্যাফেইন সরবরাহের জন্য কফির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কফি কোন পচনশীল দ্রব্য না হওয়ায় সংরক্ষণ সহজ।
কফি চাষের জন্য জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ অম্লীয় মাটি ও হালকা ছায়াযুক্ত উঁচু ঢালু জমি প্রয়োজন। আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ু বিশেষ করে দেশের পাহাড়ী এলাকাসমূহ বানিজ্যিকভাবে কফি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ফসলটি ছায়া পছন্দ করায় অন্য ফল বাগানের ভিতরে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। ফসলটি উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং বিশেষভাবে অন্য ফল বাগানের ভিতরে অল্প খরচে চাষ করা যায়। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসলে পরিণত হচ্ছে। পার্বত্য জেলায় কৃষিতে পরিবর্তনমুখী অর্থকরি ফসল কফি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত ১০-১৫ বছর ধরে বান্দরবান জেলায় কফির চাষ হচ্ছে। পাহাড়ের পতিত জমিতে স্থানীয় নৃগোষ্ঠী বিশেষ করে বম, লুসাই, মারমা এবং ত্রিপুরা চাষিদের একাংশ সাথী ফসল হিসেবে লাভজনক কফি চাষ করছেন। এভাবে একদিন হয়তো তারা জুমভিত্তিক চাষাবাদ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জমির মধ্যে প্রায় ১ লখ ৩৪ হাজার হেক্টর অনাবাদী জমি রয়েছে। অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে কৃষকগণ তাদের খাদ্যের চাহিদা মিটাতে পাহাড়ের ঢালে অপরিকল্পিত ভাবে চাষাবাদ করে থাকেন। এর ফলে একদিকে যেমন-ভূমি ক্ষয় এবং ভূমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়। এখানে পরিকল্পিতভাবে কফি, উদ্যান ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। পাহড়ি এলাকার জেলা যেমন খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় কফি চাষ করলে পরিবেশগত সুবিধা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি প্রতিকূল পরিবেশগত পরিস্থিতি থেকে উদ্ভিদকূল রক্ষা পায় এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ কম হয়।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নামে প্রকল্প চলমান রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনা করে উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) কফি ফসলের উপর গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে এ পর্যন্ত কফি্র দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে। আশার কথা জাতগুলো কৃষকদের মাঠে সন্তোষজনক ফলন দিচ্ছে।
কৃষক জিতেন ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির আলুটিলায় প্রায়.২০২২ সালে বারি উদ্ভাবিত ৮০০ টি কফি গাছ রোপন করেন। সেখান থেকে এ বছর কফি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরনের পর দোকানে বিক্রি করা শুরু করেছেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কাপ কফি বিক্রি করে প্রায় ১৫০০ টাকা লাভ থাকে। জিতেন ত্রিপুরায় সাফল্যের গল্প হয়তো কেবলি শুরু। অচিরেই অন্য কৃষকরাও সাফল্যের মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।
কফি উৎপাদনের সাথে প্রক্রিয়া এবং বাজারজাতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় মালামাল ব্যবহার করে বারির বিজ্ঞানীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি যেমন, কফি পাল্পার, কফি রোস্টার এবং কফি গ্রাইন্ডার মেশিন উদ্ভাবন করেছে। দেশে বেশকিছু কফি ব্যবসায়ী তথা উদ্যোক্তা কফি উৎপাদন ও বাজারজাতকরনে নেমে পড়েছেন। দেশে আমদানীকৃত বিনকফির দাম বেশী হওয়ায় আমদানীকারকগণ ইনস্ট্যান্ট কফি বেশী আনছেন। আমাদের দেশে কফি উৎপাদন ও বাজারজাত করা গেলে বিদেশ থেকে যেমন কফি আনতে হবে না তেমনি একটি নতুন পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা যাবে। এমনকি অর্থকরী ফসল কফি আবাদের মাধ্যমে দেশের পাহাড়ী এলাকার কৃষকদের জীবনমান বদলে দিতে পারে।
লেখক: প্রকল্প পরিচালক, কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প; চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট