০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:০৭ পিএম
বিগত শতাব্দীর ১৯৭১ সাল। তেইশ বছরের বৈষম্যমূলক শাসনের পর বাংলার ওপর নেমে আসে চূড়ান্ত অপশাসনের কালো ছায়া। আগের রাতেই সংঘটিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। যাঁকে নেতা মনে করেছিল এ দেশের মানুষ, তিনিই স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেন শত্রুপক্ষের হাতে। দেশ তখন অভিভাবকহীন, হতবাক, স্তব্ধ। কিন্তু এ জাতি তো পরাজিত নয়, পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে। তখনই পর্দার আড়াল থেকে এক সাহসী চরিত্রের আবির্ভাব, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে যুদ্ধে নামার আহ্বান জানান। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু মুক্তির লড়াইয়ে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের জয় হয়, জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা কি সত্যিই এসেছে? স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেন দেশের শাসনভার। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকেই যেন নতুন করে ঘুণ ধরতে শুরু করে নবজাত রাষ্ট্রে। পাকিস্তানি শাসনের শৃঙ্খল ভাঙলেও, ভারতীয়-রুশ প্রেসক্রিপশনে দেশে চাপিয়ে দেওয়া হয় সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে এই দুই মতবাদই হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তরায়।
সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয়করণ করা হলো : সব শিল্প-কারখানা, ব্যাংক-বিমা। কিন্তু যাদের হাতে দায়িত্ব গেল, তারা ছিল দলীয় ক্যাডার। উৎপাদন ব্যবস্থায় ভর করল অরাজকতা, অদক্ষতা আর দুর্নীতি। অচল হয়ে পড়ল অর্থনীতি। ১৯৭৪ সালে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, হাজারো মানুষ না খেয়ে প্রাণ হারায়। সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ তখন চূড়ান্ত রূপ নেয়; বাকশালের মাধ্যমে, নিষিদ্ধ হয় গণতন্ত্র, বন্ধ হয় অধিকাংশ পত্রিকা, নিঃশব্দ হয়ে পড়ে জাতির কণ্ঠস্বর।
এই সময়ের আরেকটি বড়ো রাজনৈতিক ভুল ছিল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা মানবেন্দ্র লারমা একবার শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, “আমরা আমাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি চাই।” জবাবে মুজিব বলেন, “তোরা সবাই বাঙালি হয়ে যা।”এই এক বাক্যেই মুছে দেওয়া হলো দেশের বহু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হলো : একক পরিচয়, যা বৈচিত্র্যের দেশটিকে ঐক্যের বদলে বিভক্ত করে তোলে।
এই ভয়াবহ অস্থিরতার পটভূমিতে আসে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক আর সাধারণ মানুষের মিলিত আন্দোলনে নতুনভাবে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। সেই সংকটের মুহূর্তে দায়িত্ব নেন এক সাহসী সেনানায়ক, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। শুরু হয় এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা।
জিয়াউর রহমান হাতে নেন রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের দায়িত্ব। বাতিল করেন একদলীয় বাকশাল, ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। শেখ মুজিবের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনি প্রবর্তন করেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, এক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রদর্শন, যেখানে সব নাগরিক, সব জাতিসত্তা, সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ সমানভাবে জায়গা পায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন, সমাজতন্ত্র বাংলাদেশকে কোথাও নিতে পারবে না। তাই তিনি তুলে নেন জাতীয়করণ, উৎসাহ দেন বেসরকারি উদ্যোগকে। তাঁর সময়েই শুরু হয় গারমেন্টস শিল্পের বিকাশ, প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর সরকারি উদ্যোগ, কৃষিতে ‘শস্য বিপ্লব কর্মসূচি’। তাঁর দর্শন ছিল স্পট “অর্থনীতি হবে মানুষের জন্য, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দেশের উন্নয়নে অংশ নেবে।”
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, স্বাধীনতা কেবল ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা, যা ধর্ম, ভাষা, জাতিসত্তা, সব ভেদরেখা অতিক্রম করে সমগ্র জাতিকে এক সুতোয় গেঁথে দেয়। এটি এমন এক রাষ্ট্রদর্শন, যেখানে একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষও গর্বভরে বলতে পারেন, “আমি বাংলাদেশি।”
এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদই আজও আমাদের ঐক্যের প্রতীক, আমাদের অস্তিত্বের মর্মকথা। এটি এমন এক দর্শন যা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে।
বাংলাদেশ আমাদের মায়ের মতো, মমতার মতো। দীর্ঘ অন্ধকারের পর আজ আমরা আবারও দাঁড়িয়েছি নতুন সম্ভাবনার দোরগোড়ায়। সমাজতন্ত্র কিংবা সংকীর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়, এই মাটির সঙ্গে মিশে আছে সেই দর্শন, যা একদিন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। এটাই আমাদের ঐক্যের ভিত্তি, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার দিশা। যিনি হাতে নিয়েছিলেন সেই আলোর মশাল, তাঁর নামই বাংলাদেশের আরেক নাম, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক