হাবীব ইমন
২৫ জুন ২০২২, ০৯:৩৯ এএম
এক.
পদ্মা সেতু-কেউ বলেছে স্বপ্নের সেতু, কেউ বা বলছেন গর্বের। অস্থির, প্রবল খরস্রোতা, প্রমত্তা পদ্মা শাসন করে অবশেষে যে সেতু বাংলাদেশের সাফল্যের পালকে ঝলমল করছে, তা আত্মনির্ভরশীলতার স্মারক। বাঙালি যে একরোখা, তারা যে পারে, কতো নিপুণভাবে পারে-পদ্মা সেতু তা দেখিয়ে দিল। জেদ আর একাগ্রতা মর্যাদা বাড়ায়নি কেবল, বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও দৃঢ়চিত্তে লক্ষ্যে অবিচল থাকলে অসম্ভব কিছুই নয়।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আগাগোড়াই চ্যালেঞ্জের ছিল। নির্মাণকাজের প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ এসেছে। এখানে নদীশাসন যেমনটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি নদীর তলদেশে পাথর না থাকায় পাইলিং করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেতুর নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশাল ও অপূর্ব নির্মাণশৈলি। এই সেতুর সামনে এলে আর মনে থাকে না এর নির্মাণব্যয়, সময়ক্ষেপণ এবং রাজনৈতিক মালিকানাকেন্দ্রিক বিতর্কের কথা। কেবল মনে হয়, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস আর অর্জনের অনন্য বার্তা।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ভাষায় আনন্দের এই ঐক্যের ছাপ নেই। এমন ধারণা দেওয়া হচ্ছে, পদ্মা সেতুরও আছে শত্রুমিত্র। এই সেতুর আনন্দে তাই এই অংশীদার নয় শত্রুপক্ষ। পদ্মা সেতুর আসলে শত্রু নেই। অজাত শত্রু।
শত্রু শত্রু কথা শুনতে ভালো লাগছে না। সে কথা বরং থাক আজ। বরং রবীন্দ্রনাথের মতো আমরা বলি-‘আজি দখিন-দুয়ার খোলো—/এসো হে ...’। রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে ১২২ বছর আগে লিখেছিলেন এই গান।
দুই.
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে অর্থনৈতিক তৎপরতা। সেই বিবেচনায় পদ্মা সেতুর তাৎপর্য এখন অনেক বেশি। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন থেকে শুরু করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধির বিকাশে এ সেতু সহায়ক হবে।
পদ্মা সেতুর বড় দিক হলো মধ্যপশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ফেরি পারাপারের দীর্ঘসময় অপচয় ও ভোগান্তির অবসান। এর অর্থনৈতিক উপযোগ হচ্ছে কর্মমুখী যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের সময়, জ্বালানি খরচ, শ্রমঘণ্টা সাশ্রয়। এ অঞ্চলকেন্দ্রিক কাঁচা ও পচনশীল কৃষি ফলন ও মৎস্য অর্থনীতিকে গতিশীল করবে পদ্মা সেতু।
পদ্মা, যমুনা, মেঘনা-এই তিন নদী বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে মূল তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। ঢাকা ঘিরে মধ্যাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ নিয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা, মেঘনা-গোমতী, বঙ্গবন্ধু ও ভৈরব সেতু নির্মাণের ফলে মধ্য, পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হয়। সারাদেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতায় বাধার কাজটি আটকে ছিল পদ্মা নদীর কারণে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, পদ্মার ওপারের ২১টি জেলায় ১৩৩টি উপজেলা আছে। এর মধ্যে ৫৩টি উপজেলা উচ্চ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। এসব উপজেলার মধ্যে ২৯টি বরিশাল বিভাগে। এছাড়া ৪২টি উপজেলা মধ্যম দারিদ্র্য এবং ৩৮টি নিম্ন দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। সেতু চালুর পর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে দ্রুত ওই এলাকার মানুষের আয় বেড়ে দারিদ্র্য বিমোচন হবে।
বিনিয়োগের দিক থেকে দক্ষিণাঞ্চলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব। বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি হয়। এসব পণ্যবাহী ট্রাককে যমুনা সেতু ঘুরে কিংবা মাওয়া ফেরি দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। বেনাপোল থেকে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় আসতে এখন ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা লাগে। পদ্মা সেতু হলে ৬-৭ ঘণ্টায় পণ্য পরিবহন করা যাবে। এতে আমদানি-রফতানিতে খরচ ও সময় বাঁচবে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এই সেতু। যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেতুটি।
২০০৫ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালু হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
তিন.
পদ্মা সেতু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কিছু মনোকষ্ট থাকতে পারে। থাকাটা স্বাভাবিক—জল তো অনেক ঘোলা হয়েছিল। সরকারকে অনেক নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে তার জন্য। বিশ্বব্যাংক সরে আসার পর সরকারকে অভিযুক্ত করে যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে সরকার আদৌ এটি সম্পন্ন করতে পারবে কিনা, এ সন্দেহ বা উপহাস করা হয়েছিল, তাতে বাড়াবাড়ি থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বন্ধ হওয়ার পেছনে কারও হাত থাকলেও সরকারকে তা ক্ষুব্ধ করতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও উচ্চ আকাঙ্খা বাঙালিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। স্বনির্ভরতা, সাহস, সক্ষমতায় দাঁড় করিয়েছে। এ ইতিবাচক প্রাপ্যকে আমাদেরকে মানতেই হবে। সরকারেরও উচিত আজ এই আনন্দ দিনে সবাইকে শামিল করা। এর অংশীদারিত্ব, মালিকানা থেকে কোনো একটি মানুষ যেন বাদ না পড়ে। একইসঙ্গে বন্যায় আক্রান্ত মানুষকেও আনন্দের সেই যাত্রায় শামিল করা দরকার।
চার.
সেতু বিভাগ বলছে, পদ্মা সেতুর পাইল বিশ্বে গভীরতম। এ কাজ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু যখন হয়, তখন সেটির পাইলও ছিল বিশ্বে গভীরতম। এখন পদ্মা সেতু বিশ্বে গভীরতম ভিত্তির সেতু বলা যেতে পারে। প্রকৌশলীদের কাছে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু কঠিনই ছিল না, ছিল অতীব দুঃসাহসের কাজ।
বিস্ময়কর প্রযুক্তি যদি হয় প্রধান বিশেষত্ব, দ্বিতীয়টি নিজের অর্থায়নে তা নির্মাণ। এক পয়সাও বিদেশি সাহায্য নেওয়া হয়নি। সম্পূর্ণ নিজেদের টাকায় তৈরি এ সেতু। কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী তথা জনগণের উপার্জিত টাকায় পদ্মা সেতু হয়েছে। এটা আমাদের গৌরবের। অর্থের নয়-ছয় নিয়ে অনেক আলাপ হয়তো আছে, কিন্তু দেশে-বিদেশের ষড়যন্ত্রকে রুখে পদ্মা সেতু তৈরি করা সহজ কথা নয়। পদ্মা সেতু শুধু চমকপ্রদ অধ্যায়ই নয়, এক দূরন্ত মাইলফলকও। আবার ফিরে আসা বিশ্বব্যাংককে ‘না’বলার যে হিম্মত দেখাতে পেরেছে, এটা নিশ্চয় স্বাবলম্বীতার অর্জন, এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে, এটা আর বলা অপেক্ষা রাখে না।
আদিগন্ত বিস্তৃত প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে জেগে ওঠা পদ্মার সেতুর দিকে তাকালে তার প্রতিটি স্প্যান থেকে ঠিকই বের হতে দেখা যাবে আত্মনির্ভর বাংলাদেশের আলো।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের এ বড় গর্বের। অহংকারের। বড় আত্মবিশ্বাসের। বড় স্পর্ধার। যে স্পর্ধা সবসময় উড্ডীন থাকবে, পদ্মার বুক চিড়ে কিংবা অন্য কোনো নদীর বুক চিড়ে-ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে’।
লেখক: সাংবাদিক