ঢাকা মেইল ডেস্ক
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০২:০২ পিএম
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম খুনি, স্বৈরাচার, দুঃশাসক, গণতন্ত্রহরণকারী, দেশদ্রোহী শেখ হাসিনার পলায়নের দিন। তাই আগস্ট সীমাহীন অনুপ্রেরণার। মাথানত না করার ইতিহাস। এইদিনে প্রায় ২ হাজার শহীদ ও ৫০ হাজার মারাত্মক আহত গাজীর রক্তশপৎ-এ আমজনতার চূড়ান্ত অভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের এক অনবদ্য জনজোয়ারের সুখ-সন্ধিক্ষণ। গতবছর ঠিক আজকের দিনে সর্বস্তরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অসন্তোষ ও প্রতিবাদ গণঅভ্যুত্থানে চূড়ান্ত রূপ নেয়; যা পরবর্তীতে পরদেশ আশ্রিতার অপশাসনের মূলে অগ্নিলাভা ঢেলে দেয়। ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন, বাক-স্বাধীনতা হরণ, নির্বাচনী জালিয়াতি, শত্রুরাষ্ট্রের কথায় জঙ্গিনাটক সৃজন-মঞ্চায়ন, মুসলিম নিধন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ অবশেষে অগ্নিগিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। তবে এই অভ্যুত্থান শুধু সরকার পতনের আহ্বান ছিলো না; এটি ছিলো সুশাসন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্গঠনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয়ের প্রবল বহিঃপ্রকাশ।
প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক-মাস্টারমাইন্ড ছিলেন, শহীদ আবু সাইদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজসহ অসংখ্য শহীদ ও আহত যোদ্ধাগণ। শহীদ আবু সাইদ-এর মৃত্যুই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে বেগবান করে। যে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে সরকার দিশেহারা হয়ে তল্পিতল্পাসহ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু আ.লীগ সরকারের এই ঐতিহাসিক পলায়নের কারণ কি শুধুই সরকারি চাকরিতে বৈষম্য; নাকি ভেতরে ভেতরে জনগণের অন্যরকম মারাত্মক ক্ষোভ ছিল? সেটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ধার্মিক মুসলমান নিধননীতিই মূলত সেই ক্ষোভ, যা ছাত্র-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও সরকার মূলত মুসলিমবিরোধী কাজ করে বিদেশি প্রভুর মন জোগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজ রোজা করলেই শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হতো। মসজিদ-মাদরাসা ও বাসা বাড়ি থেকে সাধারণ নামাজিদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো হতো। দেশের সকল প্রান্তে ওয়াজ-মাহফিলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পণ্ড করে দেওয়া হতো। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রচার না হলেও ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে তা দেশের আনাচে-কানাচে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়তো। ফলে ৯৫ শতাংশ মুসলমানের দেশে আলেম-ওলামা ও নামাজি ছাত্র-শিক্ষক সাধারণ মানুষের উপর এমন অপবাদ ও মিথ্যা রটিয়ে নিপীড়ন, গুম, খুন, আয়নাঘরে বন্দী করে রাখার মতো মানবতাবিরোধী কাজ বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কখনোই ভালোভাবে নেয় নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে হাজার বছরের নিকৃষ্টতম মিথ্যা প্রতিষ্ঠা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ আলেম, রাহবার, দ্বীনের দাঈই এদেশের সব মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা আল্লামা সাঈদী হুজুরের উপর ভারতের প্রেসক্রিপশনে বিনাপরাধে জেলখানায় আবদ্ধ রাখা ও নিপীড়ন করা এবং সর্বশেষ তাঁকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে দেওয়াও জনগণ একেবারেই গ্রহণ করতে পারে নাই।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- মহান স্বাধীনতার ঘোষক বীর-উত্তম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সাজানো মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে জেল খানায় প্রেরণ। বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কোনক্রমেই গ্রহণ করতে পারে নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সৎ রাষ্ট্র নায়ক জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে নির্যাতন করে মেরুদন্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বিদেশে যেতে বাধ্য করার পেছনেও যে ভারতের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো সেটি সচেতন নাগরিকের বুঝতে বাকি ছিলো না। আর সেই ভারতের কথাতেই হাসিনা দেশ চালিয়েছে। সুতরাং জনক্ষোভ প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের মতো রূপ নেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ কোন নির্বাচনেই জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের আলেম নিধন, গণতন্ত্রহরণ, জঙ্গিনাটক, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিন্দুদের প্রদান। এসব বিবিধ বিষয়ের সাথে ভারতের সংযোগ থাকায় বাংলাদেশের মানুষ ভারত বিদ্বেষী- তথা আ.লীগ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। জনগণের এইরূপ গণগণে ক্ষোভে ২৪ এর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা অগ্নিসংযোগ করার সাথে সাথেই তা দাউ দাউ করে দাবানলের মতো বিধ্বংসী চেহারায় পরিণত হয়।
গণপ্রত্যাশা
জুলাই অভুত্থানে জনপ্রত্যাশা ছিল- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বৈষম্যবিলোপ, একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থার টেকসই বন্দোবস্ত। এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপোষহীনতা। এগুলো ছিলো মূল চাওয়া। এর বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন: ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত রাষ্ট্র কাঠামো। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। যেখানে প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে, নির্বাচন কমিশন হবে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য, এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে সমান সুযোগের। তাছাড়াও বহুদিনের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি ও দলীয়করণ যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, তা থেকে মুক্তি চেয়েছিল জনগণ। তারা চেয়েছিল একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনবান্ধব প্রশাসন। দুর্নীতি দমন কমিশন হবে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ। কারও অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করবে না। নিজস্ব অভিজ্ঞ সৎ যোগ্য কর্মকর্তাদের দিয়ে গড়ে উঠবে সত্যিকার দুর্নীতি নির্মূলকরণ ফোর্স।
এতদ্ব্যাতীত বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও অত্যন্ত গুরুত্ববহ। একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি ছিলো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি। সরকার ও শাসকগোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার আশাই মানুষকে রাস্তায় নিয়ে এসেছিল। সাথে সাথে নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মানুষ চেয়েছিল জীবনের নিরাপত্তা এবং মানবিক মর্যাদা। রাষ্ট্রের সর্বস্তরের বৈষম্যবিলোপ চেয়েছিলো মানুষ। মানুষ চেয়েছিল দ্রব্যমূল্য কমবে, ডলার সংকট কেটে যাবে, রেমিটেন্স বাড়বে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নত হবে। চেয়েছিল বেকারত্ব কমবে, কর্মসংস্থান বাড়বে ও ব্যবসা সহজ হবে। তরুণ সমাজের প্রত্যাশা ছিলো- বৈষম্যের বিলোপ। যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থান। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নেতৃত্ব। কূটনীতি ও আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে সম্মানজনক সম্পর্ক। জনগণ চেয়েছিল- দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ক্যাডার। যার মাধ্যমে বন্ধ হবে দেশের সর্বত্র দুর্বৃত্তায়ন।
কী পেলাম?
ছাত্র-জনতার চাওয়া ছিলো-সর্বস্তরে বৈষম্যবিলোপ। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। কারণ হাসিনাকে হায়েনা হতে সহযোগিতা করেছিল, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন (মূলত অ্যাডমিন ক্যাডার), পর্দার আড়াল থেকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা সবাই একটি টীম হয়েই কাজ করেছে। এবং তাদের শিক্ষা ও দীক্ষাগুরুই ছিলো ভারত, তথা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। অথচ এতো এতো ছোট ছোট বাচ্চা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের রক্তের উপর দিয়ে যে সরকার গঠন হলো তা গণঅভ্যুত্থানের স্প্রিটকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধারণ করে না। এর কারণ হলো বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের মূল কারিগর শুধু সিইসি নয়। তিনি অনেক কুশীলবের একজন মাত্র। অথচ এর বাইরেও তৎকালের সকল মুখ্যসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রধান এবং বাহিনী প্রধানগণ দায়ি। কিন্তু রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যে সরকার এলো সেই সরকারের শপৎ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন- আমি ও ডামি নির্বাচনের কুশীলব ক্যাবিনেট সচিব সাহেব। এখনও পর্যন্ত সরকার এই সব বিকৃত আমলাদের উপর ফ্যাসিস্ট যুগের চেয়েও অধিক নির্ভরশীল। ফলে আমলারা আগের মতোই সুপার নিউমারারি-সহ সকল পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। অন্যান্য দপ্তরের পদ দখল ও বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে জোরপূর্বক প্রেষণে নিয়োগ নিচ্ছেন। সমাজসেবা, দুর্নীতি দমন কমিশন, ট্যাক্স, পাসপোর্ট সর্বত্র তারা দখল বাণিজ্য চালাচ্ছে। অথচ এদের ব্যাপারে সরকার নির্বিকার। এসব বিষয়ে যারা প্রতিবাদ করবে তারাও সুবিধাবাদ জিন্দাবাদে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সত্যিকার অর্থে যে সংস্কার প্রয়োজন ছিলো তা হয় নি। হওয়ার সম্ভাবনাও আর এখন নেই। আহারে দুর্ভাগা জাতি!!!
এইসব অনাচারের ফলাফল হচ্ছে- দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপণ্যের সব কিছুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। খুন-ছিনতাই রাহাজানি, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। যে এনসিপির কাছে জাতির সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিলো সুশাসন ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়বে তারাই এখন দেশের সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজ। শুনতে খারাপ লাগলেও এটিই সত্য যে, বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য ও দাতাগোষ্ঠী রয়েছে। এরপরও বিএনপি চাঁদা উত্তোলন এবং জামায়াত ইয়ানাত গ্রহণ করে। কিন্তু এনসিপির আয়ের উৎস কী? একদিন ইতিহাস এই প্রশ্ন করবে? জবাবের জন্য এনসিপি প্রস্তুত তো?
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা থাকলেও ডলার সংকট প্রকট হয়েছে। এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়েছে, ফলে আমদানি হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে শিল্প খাতেও স্থবিরতা এসেছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। এর প্রভাব পড়েছে শিল্প, কৃষি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। সরকারি চাকরির নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব আগের মতোই বিদ্যমান। ফলে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখীতা বাড়ছে। কারণ তারা দেশে আশার আলো দেখছে না। জাতির প্রত্যাশা ছিলো- একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি, যেখানে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল দেশের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক থাকবে, এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু ভারতের প্রতি অত্যধিক নির্ভরতা বহাল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। পক্ষান্তরে চীনের বিনিয়োগে কিছু অগ্রগতি লক্ষণীয়, তবে ঋণের ফাঁদ নিয়ে উদ্বেগ অমূলক নয়। ভারতকে ত্যাগ করে চীনের সাথে পাল্টা বন্ধুত্বের খেলা চলছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে সরকার কোথাও সফলতা দেখাতে পারে নি। শুধু দেশকে গৃহযুদ্ধমু্ক্ত, ভারতের আক্রমণমুক্ত ও আন্তর্জাতিক শক্তিশালী কিছু দেশের সমর্থন আদায় ব্যাতীত। তবে এ-সবই ড. ইউনুসের একক ব্যক্তি ইমেজের কারণে সম্ভব হয়েছে। আর ছোট ছোট দু-একটি যে অর্জন আছে, তা যে-কোন দেশের যে-কোন সরকারের রুটিন কার্যাবলীর মধ্যেই পড়ে।
অন্তবর্তী সরকারের এই ব্যর্থতার মূল কারণ নেতৃত্বের সংকট। গণঅভ্যুত্থানের ফলাফলস্বরূপ যেসব নেতৃত্ব উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই দূরদর্শিতা ও দক্ষতার অভাব ভয়াবহ। কেউ কেউ ক্ষমতার লোভে আগের শাসকদের কৌশলই অনুকরণ করছে। প্রশাসনিক কাঠামো এখনো অপরিবর্তিত। বিভিন্ন অধিদপ্তর-দপ্তর প্রধান ফ্যাসিস্ট আমল থেকেই চেয়ারে আছেন। মুখে মুখে জুলাই যোদ্ধারের কথা বললেও হাসিনার জন্য এদের অন্তর কেঁদে ওঠে হু হু করে। সারারাত কেঁদে কেঁদে বালিশ-কাঁথা ভিজিয়ে ফেলেন এরা। তারা নাকি সমন্বয়কদের ম্যানেজ করেই বহাল তবিয়তে আছেন। কোন সমন্বয়ক এই লেখার বিরোধীতা করার আগে বিভিন্ন দফতরে যে ফ্যাসিস্ট আমলের দপ্তর প্রধান আছেন তাদেরকে তাৎক্ষণিক বদলি করে আসবেন। তাহলে প্রমাণিত হবে আপনি বা আপনারা রিয়াদ নন। তাই বদলেছে সরকার, বদলায়নি প্রশাসনিক যন্ত্র। ফলে যতোদিন যাচ্ছে পুরনো রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি দৃশ্যমান হচ্ছে।
প্রতিটি লেখাতে সুপারিশ করি। কিন্তু হতাশা আজ এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, লিখতে মন চাচ্ছে না। তারপরও সরকারের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করি ক্ষমতার মোহে না পড়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। সুন্দর শাড়িতে সাজলেই হয় না। রাধতে জানতে হয়। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে দ্রুতই জাতি উপকৃত হবে। তা না হলে আবারও ফ্যাসিবাদি যুগ ফিরে আসবে। ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর- প্রশাসন ক্যাডার। এই ক্যাডারটি বিলুপ্ত করে ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ এই নীতি বাস্তবায়ন অত্যন্ত যুগোপযোগী। এতে ব্রিটিশ কলোনিয়ালইজমের অবসান হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈষম্যমু্ক্ত ন্যায়বিচার পাবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তের জন্য দুদকের নিজস্ব জনবল দিয়ে দুদক পরিচালনা করা সময়ের দাবি। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এবং তা জানুয়ারির মধ্যেই পারলে জাতির সর্বাধিক উপকার হয়। এবং সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশ স্বাধীন রাখার জন্য আইনি সুরক্ষা ও যথাযথ পরিবেশ সুনিশ্চিত করা।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিলো একটি বড় আশা ও প্রত্যাশার নাম। মানুষ বিশ্বাস করেছিল পরিবর্তন সম্ভব। এক বছর পর ফিরে তাকালে দেখা যায়, সেই আশাগুলো কল্পনার ডিকশোনারীতেই রয়ে গেছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা একটি দীর্ঘমেয়োদী প্রক্রিয়া। প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, সুশীল সমাজের সক্রিয়তা, এবং জনগণের অটল মনোবল। যে স্বপ্নে পথে নেমেছিল জনগণ, তা যেন ব্যর্থ না হয়-এই প্রত্যয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস একটানা উত্তাল জলপ্রবাহের মতো। একদিকে জনগণের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও সংগ্রাম; অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি, বিভ্রান্তি ও ক্ষমতার মোহ। গত এক বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কাল- রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে হতাশাব্যঞ্জকও। দেশের জনগণ কী চেয়েছিল, কী আশা করেছিল, এবং সেই প্রেক্ষাপটে সরকার, রাজনীতি ও রাষ্ট্র তাদের কতটা দিতে পেরেছে-তা সাধারণের কাছে বিরাট এক প্রশ্ন। এতোপ্রাণ বিসর্জনের পর এতো রক্ত দেওয়ার ১ বছর পর এসে মনে হচ্ছে- এতোটুকুই হয়েছে ‘শেখ হাসিনা ছিলো-আর এখন নেই’। তাছাড়া সর্বত্র ফ্যাসিবাদেরই কালো মেঘ। বীভৎস থাবা!! আমরা কি কেউ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর নই?
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক