images

মতামত

বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস: নবজাগরণের বাংলাদেশে তারুণ্যের প্রস্তুতি

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১৬ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম

বিশ্বায়নের গতিধারা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির প্রসারে বিশ্ব আজ অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মুখোমুখি। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘দক্ষতা’ এবং তার সবচেয়ে শক্তিশালী বাহক ‘যুব সমাজ’। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ জুলাই ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি যুব সমাজের ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা উন্নয়নের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশে এ বছরের প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গত বছর ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা’ হিসেবে অভিহিত একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এই পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর মধ্য দিয়ে তরুণদের দক্ষতায় প্রস্তুত করার নতুন প্রত্যয় সামনে এসেছে।

যুব সমাজ ও দক্ষতা উন্নয়ন: সমাজবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ

দক্ষতা অর্জন ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, যা সমাজের কাঠামো ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের সাথে সম্পর্কিত। এমিল ডুরখেইম (Durkheim, 1956) শিক্ষাকে সমাজের নৈতিক ও উৎপাদন কাঠামোর সাথে ব্যক্তিকে সংযুক্ত করার মাধ্যম হিসেবে দেখিয়েছেন। কার্ল মানহেইম (Mannheim, 1952) যুব সমাজকে কেবল বয়সভিত্তিক গোষ্ঠী নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের সক্রিয় বাহক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, দক্ষতা উন্নয়ন শ্রমবাজারের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি একটি বৃহত্তর সামাজিক রূপান্তরের পূর্বশর্ত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ। কিন্তু কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি ‘skill-gap’ সৃষ্টি করেছে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি উভয় ক্ষেত্রে বাধা। পিয়ের বুরদিয়ুর (Bourdieu, 1986) ‘cultural capital’ ধারণা অনুযায়ী, দক্ষতা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে অর্জিত প্রতিযোগিতামূলক সম্পদ, যা বাংলাদেশে শহর-গ্রামভিত্তিক বৈষম্য দ্বারা প্রভাবিত।

বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়ন: নীতিমালা ও বাস্তবায়ন

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ যে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তা দক্ষতা উন্নয়নে রূপান্তরধর্মী প্রভাব ফেলছে। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ লক্ষ তরুণকে ডিজিটাল প্রশিক্ষণে আনার লক্ষ্যমাত্রা (আইসিটি ডিভিশন, ২০২৩) চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়নের প্রতিফলন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (টিভিইটি) খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি, ‘ক্লাস্টারভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কাঠামো’ (এনএসডি, ২০২২) শ্রমবাজার ও প্রশিক্ষণের সেতুবন্ধন গড়ে তুলছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও তারুণ্যের প্রস্তুতি

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (২০২০) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ৮৫ মিলিয়ন পুরনো চাকরি বিলুপ্ত হবে, যেখানে প্রায় ৯৭ মিলিয়ন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ও সফট স্কিল-ভিত্তিক চাকরি সৃষ্টির প্রত্যাশা। বাংলাদেশে যেখানে রপ্তানি-ভিত্তিক অর্থনীতির একটি বড় অংশ এখনও শ্রমনির্ভর, সেখানে তরুণদের দক্ষতার পুনর্গঠন ও উন্নয়ন (reskilling, upskilling) অত্যাবশ্যক। Human Capital Theory (Becker, 1993) অনুসারে, দক্ষতা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ ব্যক্তি এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই দক্ষতা উন্নয়ন কেবল কর্মসংস্থান নয়, রাষ্ট্রীয় উৎপাদন কাঠামোর রূপান্তরের হাতিয়ার।

দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রগতি থাকলেও, কিছু কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। দক্ষতা ও শ্রমবাজারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, প্রশিক্ষণের মান ও সমন্বয়হীনতা, নারীদের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি সমস্যা রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও, ২০২২) রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪৮.৭% শিক্ষায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই এবং প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছেন না (এনইইটি)। এছাড়াও, শহর-গ্রামভিত্তিক সুযোগের বৈষম্য, ডিজিটাল প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা এবং ভাষাগত বাধা দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা।

বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস শুধু স্মরণীয় নয়, বরং এটি তারুণ্যের দক্ষতা বিকাশের গুরুত্বের প্রতীক। ‘নবজাগরণের বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে যুব সমাজের দক্ষতা উন্নয়ন সবচেয়ে বড় সম্পদ। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, সামাজিক পরিবর্তনের প্রধান চালক তরুণদের কার্যকরভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশকে একটি তরুণ-নির্ভর ও দক্ষতাভিত্তিক জাতি হিসেবে গড়তে আরও সুসংগঠিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য।

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)