images

মতামত

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এর তাৎপর্য

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১৮ জুন ২০২২, ০৫:০৪ পিএম

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেকোনো দেশের একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রত্যেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবায়ন, সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর ৭/অ ধারা (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতি আদেশ নম্বর ১২৭)’ - মতে  বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক  আমাদের দেশের 'বৈদেশিক মুদ্রার অফিসিয়াল সংরক্ষক, হিসাবকারক এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপক।'

একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ নির্ভর করে উক্ত দেশের আমদানি রফতানির পার্থক্যের মাত্রা বা বাণিজ্য ঘাটতি/উদ্বৃত্ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের গতি প্রকৃতি, ফরেন রেমিট্যান্স প্রবাহ, ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই), বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও আরোপিত শর্ত এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজার পরিস্থিতির ওপর।

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশই তাদের নিজস্ব মুদ্রার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে সুবিধাজনক নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। অর্থাৎ প্রত্যাক দেশ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থা তিনভাবে নির্ধারণ করতে পারে। যেমন: মুক্ত-চলমান হার (Demand and Supply Interaction), পেগড/স্থির (Fixed) হার এবং হাইব্রিড বা সংকর হার (Mixed)।

 মুক্ত-চলমান হার নির্ধারণ ব্যবস্থায় আর্থিক বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে বিনিময় হার নির্ধারিত হয়। এই ধরনের পদ্ধতিতে মুদ্রার বিনিময় হার ক্রমাগত পরিবর্তন হতে পারে।

পেগড/স্থির (Fixed) ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে, তবে এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর বা বৈদেশিক মুদ্রার যোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান পুনঃমূল্যায়ন করে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব মুদ্রার অতিমূল্যায়ন (Appreciation) বা অবমূল্যায়ন (Devaluation) করে থাকে।

হাইব্রিড বা সংকর (Mixed) হার বলতে এই দুই ব্যবস্থার সংমিশ্রণকে বুঝায়। এই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত-চলমান ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয় আবার কিছু ক্ষেত্রে পেগড (স্থির) ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়।

আগে দুই রকম পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় করা হতো। প্রথমটি ছিল- ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড তত্ত্ব’। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি দেশ নির্দিষ্ট পরিমাণ গুল্ড জমা রাখার বিপরীতে ওই দেশের নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা ছাপাত।

যেমন - বাংলাদেশ এক ভরি গুল্ড জমা রেখে ৯০০০০.০০ টাকা ছাপায়। আবার আমেরিকা এক ভরি গোল্ড জমা রেখে ১০০০.০০ ইউএস ডলার ছাপায়। এই ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হতো-  $1.00 = BDT 90.00 হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় হতো।

দ্বিতীয় তত্ত্বটি ছিল- "Par Value Theory" পদ্ধতি। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ইউএস ডলারের মাধ্যমে অন্য দেশের মুদ্রার মান নির্ণয় করত। আইএমএফ এই ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল দেশের কাছে ইউএস ডলারের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিজস্ব মুদ্রার বিনিময় মূল্য কত হবে, তা জানতে চাইত। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দেওয়া তথ্য উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করত। এই পদ্ধতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো শক্তিশালী মুদ্রা (যেমন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন, সিঙ্গাপুরী ডলার ইত্যাদি) যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য, সেই সব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করে।

কোনো কোনো দেশ এককভাবে তার নিজ দেশের কোনো ব্যাংকে বা কোনো কোন দেশ এককভাবে বিদেশে অবস্থিত কোনো ব্যাংকের (নস্ট্র অ্যাকাউন্টে) বা উভয় অর্থাৎ যৌথভাবে নিজ দেশের ব্যাংকে এবং বিদেশে অবস্থিত কোনো ব্যাংক (নস্ট্র অ্যাকাউন্টে) -এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারে।

বাংলাদেশ স্বর্ণ ছাড়াও বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করে। যেমন- মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন, অস্ট্রেলিয়ান ডলার ইত্যাদি। তবে, সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয় মার্কিন ডলারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবায়ন করা হয় মার্কিন ডলারের ভিত্তিতে।

বর্তমানে বিশ্বে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে চীনে। দেশটিতে ১৯ মে, ২০২২ তারিখের ভিত্তিতে ৩,৩০৫.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ নিয়ে ১ম স্থানে রয়েছে। ৩০ এপ্রিল ২০২২ এর ভিত্তিতে ১,৩৮৭.৫০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে জাপান রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। ৩১ এপ্রিল ২০২২ তারিখের ভিত্তিতে ১০৩৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে সুইজারল্যান্ড রয়েছে তৃতীয় স্থানে।

০৩ জুন, ২০২২ তারিখের ভিত্তিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভারত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৬০১.০৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২৭ মে ২০২২ এর ভিত্তিতে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৫৮৯.৬০ মার্কিন ডলার নিয়ে রয়েছে ৫ম স্থানে।

এপ্রিল ২০২২ এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্থান ৪৪তম এবং দেশটির রিজার্ভ রয়েছে ৪৪.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নেপাল ১০.৪৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে রয়েছে ৭৫তম স্থানে। ০৩ জুন, ২০২২ এর ভিত্তিতে ৯.২৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে পাকিস্তান রয়েছে বিশ্বের মধ্যে ৮১তম স্থানে। আফগানিস্তানের স্থান পাকিস্তানের চেয়ে উপরে অর্থাৎ ৭৮তম। কেনিয়া ৮.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ নিয়ে ৮২তম স্থানে অবস্থান করছে। ০৪ মে, ২০২২ এর ভিত্তিতে শ্রীলঙ্কার  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য।

অর্থনীতিবিদদের মতে, যেকোনো দেশের কাছে ওই দেশের তিন মাসের মোট আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ বা বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা উচিত।

উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে কৃষিখাতের প্রাধান্য, শিল্পে অনগ্রসরতা, ব্যাপক বেকারত্ব, অধিক জন্মহার, আমদানি রফতানির ঋণাত্মক পার্থক্য বা বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি এবং নিম্ন জীবনমান ইত্যাদি মৌলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া, উন্নয়নশীল দেশগুলো খাদ্যে এবং জ্বালানিতে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়।

উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতা বা স্থবিরতাগুলো থেকে না বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদন না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান না বাড়লে, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাবে।

উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য প্রচুর বৈদেশিক ঋণ এবং প্রযুক্তির প্রয়োজন। কৃষি এবং শিল্পখাত উন্নয়নের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রয়োজন।

একটি দেশের মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয়, খাদ্য ও জ্বালানির আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ এবং বিদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণের ব্যয় ইত্যাদি নির্বাহ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা একান্ত আবশ্যক।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না থাকার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থৈনতিক অবস্থা এখনও ভয়াবহ। শ্রীলঙ্কা বর্তমানে অর্থনৈতিক লাইফ সাপোর্টে রয়েছে।

পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, উচ্চ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া এবং প্রত্যাশিত ফেরেন ডিরেক্টর ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) না আসা ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তাদের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।

এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ না পেলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে মর্মে সতর্ক করেছেন সে দেশের অর্থনীতিবিদরা।

ভারতে লাগাতার কয়েক বছর ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসা এবং আমদানি বিকল্প সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি কারণে সে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করছে এবং ওই রিজার্ভ দিয়ে ১৫ মাসের বেশি সময়ের তাদের মোট আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম।

২৩ আগস্ট, ২০২১ তারিখের ভিত্তিতে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২১ মে ২০২২ তারিখের ভিত্তিতে বাংলাদেশে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪২ বিলিয়ন ডলারে এবং উক্ত রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে।

উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকার অর্থ হলো- একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দেশের অর্থনীতির ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা (shock resistance) বৃদ্ধি করে।

পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকলে সহজেই আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ এবং বিদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণের ব্যয় নির্বাহ এবং পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামো গড়তে পারা যায়।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্যা ইকোনমিক টাইমস।

লেখক: এজিএম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)