২৯ মে ২০২৫, ১১:০৮ পিএম
আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্টালিনগ্রাদের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই জিয়াউর রহমানের বীরত্ব, সাফল্য ও কৃতিত্বের ব্যাপারে যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে মুক্তকণ্ঠে উচ্চারিত এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অমোচনীয় রেকর্ড। সেই একই ভাষণে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। তিনি বলেন, “এই প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।”
কালুরঘাটের বেতার তরঙ্গ মারফত জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠে দেওয়া ঘোষণাকে সেই সময়েই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন: “স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর।” এর অর্থ খুব পরিষ্কার। এই ঘোষণার আগে আর কোনো কণ্ঠ থেকেই উচ্চারিত হয়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা, এটাই প্রথম। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে সারা দুনিয়ার সামনে দেওয়া বেতার ভাষণে তিনি কি নিশ্চিত না হয়ে এই কথা এতো স্পষ্ট করে বলেছিলেন? কেবল তাই নয়, জিয়াউর রহমান নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিবাহিনীর সাময়িক প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে সরকার গঠনের যে ঘোষণা দেন; তাজউদ্দীন আহমদের সে ঘোষণাও তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে অনুমোদন করেন। তার সে অনুমোদন স্পষ্ট হয়, ‘এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়’— এই বাক্যটির মাধ্যমে। আর এতেই স্বাধীনতার ঘোষণাকাল থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ধারাবাহিকতা পায়।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনের প্রথম বেতার ভাষণের আগে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের বৈঠক হয় তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। পয়লা এপ্রিল থেকে শুরু সেই বৈঠকে এম এ জি ওসমানীকে প্রধান করে মুক্তিবাহিনীর কমান্ড স্ট্রাকচার গঠিত হলে মুক্তিবাহিনী প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানের সাময়িক দায়িত্বের অবসান ঘটে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে অবসান ঘটে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতিকী দায়িত্ব পালনের।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দলীয় স্বীকৃতির আরেকটি রেকর্ড ইতিহাসে রয়ে গেছে। তখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। অপ্রতিরোধ্য মর্যাদায় ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত শেখ মুজিবুর রহমান তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে সদ্যস্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শাসনভার হাতে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের নেতা তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হয়ে এককোনায় সরতে হয়েছে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা সত্বেও শেখ সাহেব মুক্তিযুদ্ধে নিজের অনুপস্থিতির কারণে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। উনার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ব্যক্তি তাজউদ্দীন এবং আরও অনেক কিছুকেই তিনি খুব সহজ করে নিতে পারেন না। তাকে খুশি রাখতে তখন ঐসব প্রসঙ্গে সকলকেই খুব মেপে কথা বলতে হয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশন হয় শেখ সাহেবের সভাপতিত্বে। সেই কাউন্সিলে সকলের সম্মতিতে পাস হওয়া সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আসে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কয়েকটি কথা। তাতে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন।’
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণার মোটামুটি একক কৃতিত্ব দেওয়া হলেও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বিষয়টাকে একটু মডিফাই করে। এটাকে একেবারে মিথ্যাও বলা যাবে না। নিজের নামে স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা কয়েকবার দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা হিসেবে শেখ সাহেবের নাম তাতে যুক্ত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। কেননা জাতির ঘোর সংকটকালে তার নিজের কৃতিত্ব নেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। শেখ সাহেব তখন এই অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা। ঘোষণাটি তার পক্ষ থেকে দেওয়া হলে এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ে। এই যুক্তি ও পরামর্শ শোনার পর তিনি সেটা করতে মোটেও দ্বিধা বা বিলম্ব করেননি।
যাই হোক, শেখ সাহেব নিজে এবং তাজউদ্দীনসহ প্রবাসী সরকারের সব নেতার সম্মতিতে পাস হওয়া রিপোর্টে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এটাই একমাত্র অফিসিয়াল পজিশন এবং ইতিহাসের রেকর্ড। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ অয়্যারলেস, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার বা এর ওর মারফত বার্তা পাঠানোর যেসব গল্প চালু করেছে সেগুলোর কোনোটি কিংবা অন্য কোনোভাবে অন্য কারো স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো ভাষ্য আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের ওই রিপোর্টে নেই। ওই ঘোষণায় জিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা রোধে সারা পৃথিবীর সাহায্য চেয়েছেন বলেও স্বীকার করা হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠে প্রচারিত ঘোষণাটিকেই আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করে এবং রিপোর্টের পরবর্তী বাক্যেই বলা হয়: ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতে পেরে বাংলার মানুষ এক দুর্জয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলল। সারা বাংলাদেশে সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অপূর্ব দক্ষতা, অপরিসীম সাহসিকতা ও অতুলনীয় ত্যাগের মনোভাব নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অগ্রসর হন।’
আওয়ামী লীগের সেই ঐতিহাসিক দলিলই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আগে কিংবা পরে নয়, অন্য কোনোভাবেও নয়, জিয়ার কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা। মুজিবের নামাঙ্কিত জিয়ার সেই ঘোষণাই স্বাধীনতার তূর্যধ্বনি। এই ডাকের ফলেই স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়।
জিয়া রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার পর আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে তুচ্ছ বা খাটো করার জন্য কত রকমের কেচ্ছা-কাহিনীর যে জন্ম দিচ্ছেন তার ইয়ত্তা নেই। নিত্য নতুন সেসব গল্প বলা ফুরায় না। কিন্তু তারা ভুলে যান ইতিহাস তাদের কৃপার ভিখারি নয়। তাদের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্য ইতিহাস বসে থাকবে না। জাতীয় জীবনে যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে যায় তখন বিভিন্ন ব্যক্তি তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কারো ভূমিকা থাকে জাতীয় স্বার্থের পক্ষে, আবার কারো বিপক্ষে। ঘটনার বিকৃত বয়ান দেওয়া যায়, কিন্তু ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ঘুরিয়ে সে ঘটনাকে বদলানো যায় না। কুৎসা রটানো যায়, কিন্তু টাইম মেশিনে চড়ে পেছনে ফিরে গিয়ে পাল্টানো যায় না কারো ভূমিকাকেও। জীবনকালে ইতিহাস-নির্ধারিত ভূমিকা পালনের কারণে নন্দিত হয়ে জিয়াউর রহমান মৃত্যুর দুয়ার পেরিয়ে যবনিকার আড়ালে চলে গেছেন। তার সব কর্ম, ভূমিকা ও অবদান এখন ইতিহাসের সম্পত্তি। এগুলো বদলে ফেলার সাধ্য কারো নেই এবং কারুর স্বীকৃতি, বিকৃতি বা অস্বীকৃতির তোয়াক্কাও করে না।
লেখক পরিচিতি: মারুফ কামাল খান, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল: mrfshl@gmail.com