images

মতামত

জিয়া নয়, সেদিন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হত্যা করা হয়েছিল

২৯ মে ২০২৫, ১০:০২ পিএম

১৯৮১ সালের ৩০ মে, দলীয় সফরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে যার হাত ধরে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। সে হিসেবে জিয়া নয়, সেদিন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেই হত্যা করেছিল তারা।

তারা কারা? তারা ছিলেন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য। তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। তাহলে তারা স্বাধীনতার ঘোষক, জাতীয়তাবাদী এই নেতাকে হত্যা করেছিল কীভাবে? তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—বাংলাদেশকে সেবাদাসে পরিণত করার লক্ষ্যে, দেশকে একটি পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যই সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।

যার বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে তৎকালীন চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর লেখা আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারম্যাথ–এ। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদও তাঁর একটি প্রবন্ধে ওই রাতের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকাণ্ডের ওপর রচিত বিভিন্ন বইপত্র ও ইতিহাস গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামে বিএনপির দুটি পক্ষের অন্তর্কোন্দল মেটাতেই জিয়াউর রহমান সেদিন ইরাক ও ইরানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল করে চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলেন। সফরের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে বিষয়টি জানানো হয় চট্টগ্রামের ডিসি জিয়াউদ্দিন চৌধুরীকে। যদিও এর আগে এ ধরনের সফরের কথা সাধারণত মাসখানেক আগে ডিসিকে জানানো হতো।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই ডিসি সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। ওই সফরে জিয়ার সফরসঙ্গী ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমেদ, আমেনা রহমানসহ দলের আরও কিছু নেতা।

২৯ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রাম পৌঁছান জিয়াউর রহমান। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান বিভাগীয় কমিশনার সাইফউদ্দিন, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বদিউজ্জামান, ডিআইজি শাহজাহান এবং ডিসি জিয়াউদ্দিন। বিএনপির কিছু নেতা এবং তিন বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডাররাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তবে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল মনজুর সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ। রাষ্ট্রপতি জিয়া জিওসি মনজুরের না আসার কারণ জানতে চাইলে তাঁকে জানানো হয়, টেনিস খেলতে গিয়ে কিছুটা আহত হওয়ায় জেনারেল মনজুর উপস্থিত থাকতে পারেননি।

বিমানবন্দর থেকে জিয়া সরাসরি চলে যান ভিআইপি লাউঞ্জের বাইরে রাষ্ট্রপতির জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ি বহরের দিকে। ডিসি জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর টয়োটা করোলায় চড়ে সার্কিট হাউসের দিকে রওনা হন তিনি। সার্কিট হাউসে ঢুকেই তিনি কারও সঙ্গে কথা না বলে সোজা চলে যান তাঁর জন্য নির্ধারিত রুমে। জুমার নামাজ আদায় করার জন্য তিনি অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বেরিয়ে চন্দনপুরা মসজিদের উদ্দেশে রওনা হন। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার।

মসজিদ থেকে ফিরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জানান, ডিআইজি ও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবেন, যেখানে বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিসিও থাকবেন। তবে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা বললেও রাষ্ট্রপতি জিয়া দুপুরের খাবার সেরেই দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে কর্মকর্তারা সার্কিট হাউসে এসে জানতে পারেন, রাষ্ট্রপতি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার কথা বললেও জিয়া সম্ভবত তা ভুলে গিয়েছিলেন। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১০টার দিকে কমিশনার ওপরে উঠে জানতে পারেন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং হবে না। ফলে সবাই যে যার বাসায় ফিরে যান।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুপুরে শুরু হওয়া বৈঠক, রাতের খাবারের বিরতি দিয়ে চলে গভীর রাত পর্যন্ত। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যে যার কক্ষে ঘুমাতে যান। সে সময় সার্কিট হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীর দু’জন ছিলেন রাষ্ট্রপতির দরজার দুই পাশে। বাইরে প্রহরায় ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। ডিসির সহকারী প্রটোকল অফিসারও ছিলেন সার্কিট হাউসে কর্তব্যরত।

নিজের সেই প্রটোকল অফিসারকে উদ্ধৃত করে জিয়াউদ্দিন তাঁর বইতে লিখেছেন: ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর চারটার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রটোকল অফিসারের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখেন, সার্কিট হাউসের সামনের বারান্দার কিছু অংশ ঝুলে পড়েছে—সম্ভবত কোনো শেলের আঘাতে।

খাবার ঘরের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন, সার্কিট হাউসের গেট দিয়ে সামরিক বাহিনীর যানবাহন ঢুকছে। সেখান থেকে লাফিয়ে নামছে সৈন্যরা এবং গুলি করছে পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশ কোনো প্রতিরোধ করেনি, কারণ প্রতিরোধ বৃথা—তারা তা বুঝতে পেরেছিল। ডাইনিং রুমের টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকা প্রটোকল অফিসার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির ঘরের দিকে যাওয়া সৈন্যদের বুটের আওয়াজ শুনতে পান। সেখান থেকে ভেসে আসে গুলির শব্দ, আর্তচিৎকার।

প্রটোকল অফিসারের মতে, প্রায় এক ঘণ্টা এই তাণ্ডব চলার পর সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো সার্কিট হাউস ছেড়ে যায়। তিনি খাবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেন, সামনে পড়ে আছে রাষ্ট্রপতির গার্ডের একজনের মৃতদেহ। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন, রক্ত। এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রটোকল অফিসার পালিয়ে যান, সার্কিট হাউসের পাশে ট্রান্সপোর্ট পুলে।

গুলি ও মেশিনগানের শব্দে আতঙ্কিত পাহারাদারের হাঁকডাকে ভোর চারটার দিকে ডিসি জিয়াউদ্দিনের ঘুম ভাঙে। টেলিফোনে এই অফিসারের কাছ থেকেই তিনি সার্কিট হাউসে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রথম বর্ণনা শোনেন। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন কিনা সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি প্রটোকল অফিসার। এর কিছুক্ষণ পর বিভাগীয় কমিশনার ডিসিকে ফোন করে লে. কর্নেল মাহফুজের বরাত দিয়ে জানান রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন।

ডিসি জিয়াউদ্দিন নিজে গাড়ি চালিয়ে বিভাগীয় কমিশনার সাইফউদ্দিনকে পথ থেকে তুলে নিয়ে যখন সার্কিট হাউসে পৌঁছান, তখন ভোরের আলো ফুটেছে। সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলেন ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার এবং এসপি। তারা দেখতে পান, দেয়ালে গুলির দাগ, গোলার আঘাতে উড়ে গেছে ছাদের একটা অংশ, কাঠের টুকরো পড়ে আছে গাড়িবারান্দায়। সেখানে প্রচুর রক্ত।

দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার তাদের জানান, প্রাথমিকভাবে বাইরে থেকে সশস্ত্র সৈন্যদের একটি কনভয় এবং পরে ভেতর থেকে সৈন্যদের একটি দল সার্কিট হাউস আক্রমণ করে। এরপর চলে মেশিনগানের গুলি। রাষ্ট্রপতির রুম লক্ষ্য করে রকেট শেল ছোড়া হয়, কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছাদে আঘাত হানে। ফলে ছাদের একটি অংশ ভেঙে পড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়েছিল, কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারেনি। আক্রমণকারীরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাবেষ্টনীর সব সদস্যকে হত্যা করে।

এরপর ডিসি জিয়াউদ্দিন রাষ্ট্রপতির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে মেঝেতে পড়ে ছিল একটি মৃতদেহ, যার মুখ চাদর দিয়ে ঢাকা। চাদর সরাতেই একজন গার্ড বলেন, ‘স্যার, উনি প্রেসিডেন্ট জিয়া।’

সার্কিট হাউসে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসে জিয়ার লাশ নিয়ে যেতে। এর আগে মরদেহটি গোপনে নেওয়া হয়েছিল রাঙুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে স্থানীয় কয়েকজনকে অস্ত্রের মুখে কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকেই মরদেহ উত্তোলন করে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়। কফিন খুলে দেখা যায়, একই কফিনে রয়েছে তিনটি মরদেহ। এ ঘটনায় স্থানীয় মানুষ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে।

সেদিন দুপুরে হাজারো মানুষ সার্কিট হাউসে ভিড় করেন রাষ্ট্রপতির মরদেহ একনজর দেখতে। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে রাষ্ট্রপতির মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো এবং আত্মীয়স্বজন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুখ দেখে শেষ বিদায় জানান।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। মধ্যপন্থী, উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ ছিল দলের মূল দর্শন। বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। একাত্তরের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেন। এমনকি বিলুপ্ত আওয়ামী লীগকেও রাজনীতিতে ফেরান।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। আর তার ১৩ দিন পর হত্যা করা হয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করেন।

তবে আজও টিকে আছে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি। তার রাজনৈতিক দর্শন ও উদারনৈতিক পথ বহু বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এখনো দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়।

——লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও মানবাধিকার গবেষক