images

মতামত

পেশাদার মনোভাব, পেশার উৎকর্ষতা ও জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি

২৫ মে ২০২৫, ০২:৫৪ পিএম

মানুষ জীবিকার জন্য কর্মের সন্ধান করে। উপযুক্ত বা মর্যাদাপূর্ণ কর্মের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি জীবন ধারণ করতে চায়। দেশের কর্মক্ষেত্রসমূহ বিভিন্ন ধরনের। যেমন: বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য। প্রতিষ্ঠানসমূহের ধরণ ও প্রকৃতি অনুযায়ী জনবল চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হয়। সর্বক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণায় সমৃদ্ধ লোক নিয়োগ করা প্রয়োজন। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানসমূহ স্ব স্ব চাহিদা মোতাবেক জনবল সংস্থান করে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধ হয় ও পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। দেশের চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিশেষ ক্ষেত্রে পেশাদার লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু সর্বাধিক ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানে সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে নিয়োগকৃত জনবলকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা আবশ্যক। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন কর্মীকে প্রতিষ্ঠান জ্ঞানে উপযুক্ত হয়। যাতে সে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রত্যেক দপ্তর প্রশিক্ষিত জনবলের মাধ্যমে তার লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। প্রশিক্ষণ কি? ‘প্রশিক্ষণ’ হচ্ছে একজন ব্যক্তির দক্ষতার বিকাশ। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে কর্মীদের প্রদত্ত শিক্ষাই হচ্ছে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ কর্মীর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, মনোভাব ও আচরণগত উন্নতি সাধনে প্রচেষ্টা চালায়। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য প্রশিক্ষণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। প্রশিক্ষণ নব নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও ধ্যানে সমৃদ্ধকরণে সহায়ক। পুরানো কর্মীদের পরিবর্তিত প্রযুক্তি ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে প্রশিক্ষণ অনন্য ভূমিকা পালন করে। প্রশিক্ষণ একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতার বিকাশ, প্রতিষ্ঠানের অপচয় হ্রাস, সম্পদের সদ্ব্যবহার ও কর্ম নৈপুণ্যতা বৃদ্ধি করে।

13

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর দেশের অন্যতম জাতিগঠনমূলক প্রতিষ্ঠান। এ অধিদপ্তর দেশের অসহায়, বিপন্ন ও নিগৃহীত মানুষের কল্যাণে কাজ করে। ‘জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি’ সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত একটি অন্যতম বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। সমাজসেবা অধিদপ্তরে উদ্দেশ্য মাফিক পেশাদার কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা এ একাডেমির অন্যতম লক্ষ্য। নব নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার দক্ষতার বিকাশে এ একাডেমি কাজ করছে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন হতে একাডেমি অধিদপ্তরে কর্মরত-কর্মকর্তাদের পেশাগত জ্ঞান ও ধ্যান ধারণায় সমৃদ্ধ করা এবং পেশার মানোন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৬৩ সালের ১ মার্চ ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার’ নামে ইউনিসেফের সহযোগিতায় সমাজকল্যাণ একাডেমি’র সূচনা। পরবর্তীতে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সরকারিভাবে ‘সমাজকল্যাণ আন্তঃপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ নামক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় আন্তঃপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে ‘জাতীয় সমাজকল্যাণ একাডেমি’তে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ‘জাতীয় সমাজকল্যাণ একাডেমি’র নাম পরিবর্তন করে ‘জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি’ হিসেবে নামকরণ হয়। ১৯৮৪ সালে এটি একটি স্থায়ী রাজস্ব খাতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

14

১৯৮৪ সালে এনাম কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী  এ একাডেমির নির্ধারিত কার্যাবলী নিম্নরূপ:

১. সমাজসেবা অধিদপ্তরে প্রবেশ স্তরে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স (মৌলিক কোর্স) আয়োজন করা।
২. সমাজসেবা অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য সময়ে সময়ে সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও পরিচালনা করা।
৩. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার নেতৃবৃন্দ ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণ কোর্স, সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন ও পরিচালনা করা।
৪. সেবার বিশেষ ক্ষেত্র যেমন: শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ইত্যাদি প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে শিক্ষক/প্রশিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করা।
৫. বিভিন্ন প্রকল্প/প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করা ট্রেড প্রশিক্ষক/ভোকেশনাল প্রশিক্ষকদের জন্য উন্নত/উদ্ভাবনী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করা এবং পরিচালনা করা।
৬. সমাজসেবার ক্ষেত্রে জরিপ ও গবেষণা পরিচালনা করা এবং তার প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
৭. সমাজসেবা অধিদপ্তরকে কর্মসূচি পরিকল্পনা এবং উন্নয়নে, পন্থা ও কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া।
৮. নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা/সামাজিক সেবার উপর সেমিনার, কর্মশালা পরিচালনা এবং কর্মসূচির জন্য সুপারিশ উপস্থাপন করা।
৯. সমাজসেবা অধিদপ্তরাধীন আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমের নির্দেশনা প্রদান ও তত্ত্বাবধান করা।

15

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভিশন হচ্ছে দেশের জনগণের জন্য উন্নত জীবন ও যত্নশীল সমাজ বিনির্মাণ করা। এ ভিশন বাস্তবায়নে এ মন্ত্রণালয় সামাজিক সুরক্ষা, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত কর্মসূচির সংখ্যা ৫৪টি। মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ অনন্য ভূমিকা পালন করছে। চলমান কর্মসূচিসমূহ দেশের দারিদ্র বিমোচন, শিশু সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, কমিউনিটির ক্ষমতায়ন, দুর্গত-অসহায় মানুষের কল্যাণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তসহ বিবিধ বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজ করছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত কর্মসূচিসমূহ অত্যন্ত মানবিক ও সেবামূলক। চলমান সকল কর্মসূচি পদ্ধতি নির্ভর। তাই লক্ষ্যভুক্ত সেবা গ্রহীতাদের সেবা প্রদানে সুনির্দিষ্ট সমাজকর্মের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। । অন্যথায় একটি দাপ্তরিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং প্রদত্ত সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বৈচিত্র্যপূর্ণ যা বিবিধ বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রদত্ত সেবাসমূহ কল্যাণমূলক, উন্নয়নমূলক, সুরক্ষামূলক, প্রচারণামূলক ও পরামর্শমূলক। তাই প্রদত্ত সেবা অনেক ক্ষেত্রে পরিমাপন করা যায় না । জাতীয় সমাজসেবা একাডেমির অন্যতম লক্ষ্য পেশাদার সমাজকর্মী তৈরি করা। যাতে প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা পেশাদারীত্বের ভিত্তিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত প্রদত্ত সেবাসমূহ বাস্তবায়ন করা যায়।

সমাজকল্যাণ কর্মসূচি সমূহ বিবিধ সামাজিক সমস্যা উত্তরণে সহায়ক। সময়ের আবর্তে নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। তাই প্রথাগত পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক সমসজকর্ম পদ্ধতি অনুসারে কর্মসূচিসমূহের বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। ‘সমাজকর্ম’ পেশা হিসেবে নবীন এবং বিশ্বের অনেক দেশে পেশা হিসেবে স্বীকৃত। পেশার মানদণ্ড ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে সমাজকর্ম একটি পেশা হিসেবে বিবেচ্য। একটি পেশার ভিত্তি হচ্ছে পেশাগত জ্ঞান ও ডিগ্রি অর্জন, পেশাগত স্বীকৃতি এবং পেশার মানদণ্ড অনুসরণ করা। সমাজকল্যাণ কর্মসূচিসমূহ সমাজকর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করে বাস্তবায়ন বহুলাংশে  জাতীয় সমাজসেবা একাডেমির উপর নির্ভর করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জনাব মো. সাইদুর রহমান সম্প্রতি একটি বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ উদ্বোধন সমাজকর্মকে পেশাগত স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে মর্মে জানান। তাই সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিকাশ ও আধুনিকায়ন জরুরি।

16

১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠালাভ করলেও অদ্যাবধি একাডেমির প্রশাসনিক সংস্কার সাধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সময়ের আবর্তে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কার্যক্রম ও কার্যপরিধি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রেক্ষিতে জাতীয় সমাজসেবা একাডেমিকে একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের আলোকে পরিচালনা করা ও প্রশাসনিক সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দিন জাতীয় সমাজসেবা একাডেমিকে আধুনিক একাডেমিতে রূপান্তরকরণের জন্য সংশ্লিষ্টগণকে জোর নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় অতি শীঘ্রই পৃথক ও সুবিস্তৃত পরিসরে জাতীয় সমাজসেবা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান সংকটের মাঝেও একাডেমি লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের চলমান সংকটের মাঝেও চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে গ্রেডভিত্তিক বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ, কার্যক্রমভিত্তিক শর্টকোর্স, বিষয়ভিত্তিক সেমিনার, গবেষণাকর্ম, পদভিত্তিক বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ইন-হাউজ প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ চলমান আছে। চলতি বর্ষে এ পর্যন্ত মোট প্রশিক্ষণ গ্রহীতার সংখ্যা ৫৯০ জন। তাছাড়া একাডেমির উদ্যোগে ‘দি জার্নাল অব সোশ্যাল সার্ভিসেস’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যা সংশ্লিষ্টগণকে সমাজকল্যাণমূলক ধ্যান-ধারণায় সমৃদ্ধ করবে। এ জার্নালের মাধ্যমে সৃজনশীল মানুষের  সুচিন্তিত ধারণা বহুল প্রচার করা সম্ভব হবে।

জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি সমাজসেবা অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তাদের পেশাগত জ্ঞানে সমৃদ্ধকরণের অন্যতম ক্ষেত্র। পেশাদার কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করে সমাজসেবা অধিদপ্তরকে পেশাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এ একাডেমির অন্যতম লক্ষ্য। সমাজকল্যাণ কর্মের পেশাগত স্বীকৃতি চাই। একটি দক্ষ ও পেশাদার সমাজকর্মী দ্বারা সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত হোক । জাতীয় সমাজসেবা একাডেমির প্রশাসনিক সংস্কার, আধুনিকায়ন ও সমৃদ্ধকরণে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি হোক পেশাদারিত্ব সৃষ্টি ও সমাজকর্ম পেশার উৎকর্ষতার এক অনন্য ক্ষেত্র।