ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৪ মে ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম
যুদ্ধ প্রেমের মতো। প্রথমে মজা, তার পরে মূর্ছা। উপমহাদেশের দুই পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ ৮৭ ঘণ্টা স্থায়ী ছিল। জীবনের ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই। সবমিলিয়ে দুই দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার।
২২ এপ্রিল দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বৈসরন উপত্যকার পেহেলগামে নিরহ পর্যটকদের হত্যার পর দেখা দেয় যুদ্ধোন্মাদনা।
গত কয়েক দশকে এই রকম পরিস্থিতি কয়েক বার তৈরি হলেও, এবারের পেক্ষাপট ছিল ভিন্ন ধরনের। শুধু সামরিক বাহিনীর লোকজন নয়, দুই দেশের সরকার ও জনগণের একটা অংশ মনে করল যুদ্ধই একমাত্র পথ। সামাজিক মাধ্যম এমনকি গণমাধ্যমও মেতে উঠে এই যুদ্ধোন্মাদনায়, সবাই যেন মানসিক ভাবে প্রস্তুত। সবখানে উত্তেজনা, রণহুংকার আর আস্ফালন। সবাই ভুলে যায় যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক বিভীষিকা ও ভয়াবহতা।
ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো, দুই দিন পরেই পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিশোধ। বেজে গেল যুদ্ধের দামামা। গুরুতর গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা সক্রিয় হয়ে দুই দেশকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করায়।
এই যুদ্ধের বিশেষ দিক ধর্মীয়করণের প্রবণতা। দুটি দেশ যুদ্ধের নামকরণে দুই ধর্মের স্পর্শকাতর কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করে। ধর্ম যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ায় এক ধরনের অপচেষ্টা বলে অনেকে মনে করে।
প্রথম থেকে বিষয়টিকে বিষিয়ে তুলে ছিল ধর্ম। ধর্মের নামে হিংসা আর ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, যুদ্ধ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে আসলে কোনো ধর্মের কোনো উপকার হয় না। বরং বিশেষ গোষ্ঠী উপকৃত হয়। ৪৬/৪৭ সালের উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সেটা মনে করিয়ে দেয়। সরকারি হিসাবে এই দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ আর বেসরকারি হিসাবে ১২ লাখ। ইতিহাসের ভয়াবহ এই দাঙ্গায় নিরীহ হিন্দু-মুসলিমের প্রাণ গিয়েছিল, দাঙ্গাকারীদের তেমন কিছু হয়নি।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পেহেলগামে সরাসরি ধর্ম যাচাই করে খুন করা হয়। জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় এলাকাটি অনেক দিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ। কীভাবে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নজর এড়িয়ে খুনিরা আধুনিক অস্ত্র দিয়ে হত্যালীলা চালালো, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেছে। তারপর জঙ্গি আস্তানার দাবি করে, যে সব স্থানে হামলা চালনো হয়, এ থেকে আবার অনেকে ধারণা করে জঙ্গিরা কোথায় থাকে, ঘুমায় ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো সবই জানে। সেক্ষেত্রে হামলার আগে কোনো আভাস না পাওয়া নিয়েও অনেকের প্রশ্ন।
বিষয়টির একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অবিশ্বাস আর ক্ষোভের বারুদ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপ নেয়।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাধারণভাবে এটা দৃশ্যমান যে, জঙ্গিরা ইসলামের নাম করে বিশেষ কোনো সুবিধা নেওয়ার জন্য এই হামলা চালিয়েছে। আমাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, এই হামলার মাধ্যমে ২৬/২৭ জন নিরীহ হিন্দু ধর্মের অনুসারীকে হত্যা করে ইসলাম ধর্মের কি কোনো উপকার হলো? আমাদের জানা মতে, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধেও যায়, ইসলাম মানুষ হত্যা সমর্থন করে না।
পবিত্র কোরআনের সুরা মায়েদায় বলা হয়েছে, মানুষ হত্যা মহাপাপ। যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যার বিনিময় অথবা ভূপৃষ্ঠে ফ্যাসাদ সৃষ্টির কারণ ছাড়া অন্যায়ভাবে হত্যা করলো সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করলো।
সুরা বনি ইসরাইল (৩৩) বলা হয়েছে, আল্লাহ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা হত্যা কর না।
এ ব্যাপারে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব হবে হত্যার ও রক্তের। (বুখারি ৬৫৩৩)
পবিত্র কোরআনে প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাতন্ত্রকে স্বীকার করা হয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তিকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না। ধর্মীয় ব্যাপারে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার নিষেধ আছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্ম অস্বীকার করে বা না মানে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজেই পদক্ষেপ নেবেন।
অতএব ধর্মের নামে কেউ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রচারণায় এমন নির্মম কাজ করে তাহলে শাস্তি তাকেই পেতে হবে। সে জন্য ধর্ম বা সেই ধর্মের অন্য অনুসারীরা দায়ী হতে পারে না। কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে বেছে বেছে মানুষ হত্যা করল এ ব্যাপারে বৃহৎ পরিসরে তদন্তের প্রয়োজন।
ভারতে ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ১০০ কোটির বেশি মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী। হত্যা করে ভারতকে হিন্দুশূন্য করে অন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করা কতটা বাস্তবসম্মত বা সম্ভব?
মুসলিম শাসকদের এমন কথা কোনো দিন মাথায়ই আসেনি। দিল্লি বা আগ্রাতে বসে মুসলিম শাসকরা প্রায় ৫০০ বছর মূল ভারত শাসন করলেও মূল ভারতের (বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এলাকা ব্যতীত) মুসলিম জনসংখ্যা কোনো সময় ১৫ শতাংশের বেশি ছিল না।
ইউরোপীয়দের একটা ধারণা আছে, ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। কাল মার্ক্স সেটাকে লিখিত আকারে উল্লেখ করেছেন। আসলে অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশের শাসক ও রাজাদের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস নেই বা পাওয়া যায় না। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ, শিলালিপি, স্থাপনা ও জিনিসপত্র দেখে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা করা হয়।
অতি প্রাচীনকাল থেকে দেখা যায় ভারতের অধিকাংশ প্রভাবশালী শাসকরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পরবর্তী সময়ে মুসলিম শাসকরা শাসন করছে, ইংরেজরা করেছে প্রায় ২০০ বছর। হিন্দু ধর্মের ওপর যদি কোনো বড় ধরনের আঘাত আসত তবে এই ধর্মের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, হিন্দু ধর্ম এতটাই সবল যে, বৌদ্ধ ধর্মের শাসকরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে কিছুই করতে পারেনি। বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে উৎপত্তি লাভ করা সত্ত্বেও এই ধর্ম নিজেই এক সময় ভারত থেকে বিতাড়িত হয়।
উপমহাদেশের ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠী বিবেচনায় দেখা যায়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। ইসলাম যদি ভারতে তরবারির মাধ্যমে বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে আসত তাহলে দিল্লি-আগ্রার আশপাশের অঞ্চল বা মূল ভারত মুসলমান অধ্যুষিত হতো, কেননা মুসলিম শাসকরা সেখানে বসে শত শত বছর শাসন করেছে। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত, জলাভূমি বা বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন অঞ্চলে সেই অর্থে সেনা অভিযানের তেমন ঘটনা ঘটেনি; যেখানে তরবারি ছিল অনেক দুর্বল। অথচ সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। একইভাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল দিল্লি থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও উপজাতি লোকদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে সেখানে মুসলিমের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশাল অংশ বিভিন্ন জাট গোত্র থেকে আসার সত্যতা পাওয়া যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন। যিনি রিচার্ড এম ইটন নামে পরিচিত। দীর্ঘ গবেষণার পর ১৯৯৩ সালে ‘রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার-১২০৪-১৭৬০’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
তিনি প্রমাণ করেছেন, হিন্দু ধর্মের লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তার প্রমাণ খুবই কম পাওয়া যায়। বাংলায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে যে সব জনগোষ্ঠী তারা ব্রাহ্মণিক সংস্কৃতির সংস্পর্শ পেয়েছিল খুব কমই।
ইটন দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মোঘল আমলে পাললিক সমতলের, নিভৃত পল্লীর, জঙ্গলাকীর্ণ, জলমগ্ন নিম্নভূমিতে সুবিপুল দরিদ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে মুসলিম জনসংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। আর এটা সম্ভব হয়েছিল মোঘলের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও কিছু পদক্ষেপের কারণে, বিশেষ করে বাংলার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠানো মুসলমানদের কারণে, যাদের আমরা সুফি-সাধক বা ধর্ম প্রচারক বলে থাকি।
তিনি হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে বলছেন, বাংলা কোনো সময় ব্রাহ্মণদের এলাকা বা দেশ ছিল না। প্রথম দিকের হিন্দু ধর্মের গ্রন্থসমূহে ব্রাহ্মণদের পূর্ব দিকে সীমানা দিল্লির পাশে যমুনা নদী পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে পূর্ব দিকের সীমানা বিহার পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। বাংলায় মূলত অনার্যরা বাস করত। এদের নিদিষ্ট কোনো ধর্ম ছিল না। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যে যা পারত তাই করত। ভারতে অনেক ভাসমান লোক ছিল তারাই এক সময় অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।
তাছাড়া এটা ইতিহাস স্বীকৃত যে, আর্য বা ব্রাহ্মণদের আদি নিবাস মধ্য এশিয়া তারা এক সময় ইরান-ইরান-আফগানিস্তান হয়ে ভারত উপমহাদেশে এসে বিকাশ লাভ করেছে। আর্যরা এসে ভারতের ফাঁকা মাঠ দখল নেয়নি। এখানে জনবসতি ছিল। মুসলিমরাও একইভাবে সেই পথে এসেছে। কেউ আগে আর কেউ পরে। আর আমরা ভারত উপমহাদেশের লোক কেউ মুসলিম হয়েছি আর কেউ হিন্দু হয়েছি। অতএব কেউ কারোর বাড়া ভাত কেড়ে নেয়নি।
অনেকে মনে করেন হিন্দুধর্মের কঠোর জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে নিম্নবর্ণের বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। রিচার্ড এম ইটন এ ধারণা ও মানতে নারাজ। ইটন তার গ্রন্থে বলেন, পূর্ব বাংলার সমাজে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব এত দুর্বল ছিল যে, তাদের পক্ষে শোষণ চালানো সম্ভব ছিল না। ইটন এটাই দেখাচ্ছেন, ভারতের অনেক অঞ্চলে বর্ণবাদ এতই লক্ষণীয় ছিল যে, তাদের কারণে নিম্নবর্ণের মানুষ বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে তবুও তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে ইসলামের প্রসার অধিকতর লক্ষণীয় হতো। তাছাড়া জাতিভেদ প্রথার কারণে যদি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে তবে সেটা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার (বখতিয়ার খিলজী) পরপরই ঘটবার কথা ছিল। তবে তখন সেটা ঘটেনি।
অনেকের ধারণা, মুহাম্মদ বিন কাসিম, মুহাম্মদ ঘোরি ও ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর (১২০৮) মতো লোকেরা এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম নিয়ে এসেছিল। তাদের কারণে হয়ত মুসলিমরা সাহস পেয়েছিল, কিন্তু তাদের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তার নজির খুবই কম।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. ৬১০ সালে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং এই সময়ে ভারতে এমনকি বাংলায় উপকূল অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম এসে পৌঁছায়। মহানবী সা.-এর সাথে দেখা করে কেরালা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কোনডাংগালুর রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ভারতীয় সঙ্গে আরবদের ব্যবসায়ী সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন, যে কারণে আরবের মতো এই অঞ্চলেও ইসলাম প্রচার শুরু হয়।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা.-এর খেলাফতকালে (৬৩৫-৪৫) একদল ইমাম প্রচারক বাংলায় আসেন। পরবর্তী সময়ে উপকূল অঞ্চলে আরব ও পারসিক বণিকদের বসবাস বেড়ে যায়। এই অঞ্চলের রাজারাও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ভূমিদান করে, মসজিদ তৈরি করে দিয়ে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য উৎসাহ দিতেন।
রংপুর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের (কুড়িগ্রাম জেলার) রামদাস মৌজার ‘মজদের আড়া’ গ্রামে ৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে করা হয় মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের চব্বিশ বছর আগে উমাইয়া শাসক প্রথম মারওয়ানের পুত্র আবদুল মালেকের শাসন আমলেই বাংলার এই নিভৃত এলাকায় মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল।
১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন স্থানীয় দরিদ্র কৃষক শ্রেণির লোকদের ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দও একই কথা বলেছেন, ‘অতীতের অনেকে এবং ইদানীংকালের কেউ কেউ মুসলমানদের ‘বিদেশি’ বলে আখ্যাত করে থাকেন। মুসলমান শাসনের প্রথম দিকে যারা ভারত আক্রমণ করেছিল তারা বিদেশি ছিল। তবে তারা ছিল মুষ্টিমেয়। কিন্তু ভারতে লক্ষ লক্ষ যে সাধারণ মুসলমান তারা বহিরাগত ছিল না। আক্রমণকারীও ছিল না। এইসব মুসলমানরা পুরোপুরিই ভারতীয় জনসমাজ-সস্তুত। তারা পুরোপুরিই ভারতীয়।’
তিনি আবার বলেছেন, ‘ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশি কেন? একথা বলা মূর্খতা যে, তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। সেইজন্য বাংলাদেশে, যেখানে কৃষকদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান বেশি।’
কিছু দিন আগে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামে একটি ছবি ভারতে বেশ হৈচৈ ফেলেছিল। ছবির কাহিনি সত্য ও বাস্তব হিসাবে দাবি করা হয়। কাহিনি ছিল কেরলের মতো একটি অগ্রসর রাজ্যে অতি অল্প সময়ে ৩২ হাজার শিক্ষিত হিন্দু ধর্মের অনুসারী মহিলাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ‘লাভ জিহাদ’ এর মাধ্যমে শুধু ধর্মান্তরিত করা হয়নি, তাদের জঙ্গি বানিয়ে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই উপমহাদেশে ভালোবেসে বিয়ে করার ঘটনা অহরহ। প্রেমের কারণে কেউ হিন্দু হয়, কেউ মুসলিম হয়, আবার অনেক ধর্ম পরিবর্তন না করে বিয়ে করে।
‘দ্য কেরালা স্টোরি’ প্রোপাগান্ডা নাকি বাস্তবতা নাকি টাকা কামানো বা ক্ষমতা ধরে রাখার উপায়, এ নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো। তবে এটা বলা যায়, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ যদি সত্য হয় তাহলে ইতিহাস, ধর্মীয় তত্ত্ব, মানুষের সব যৌক্তিক চিন্তা সব মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে।
ইটন মনে করেন, খ্রিষ্টান ধর্ম কখনো বিকশিত হতো না, যদি না তা ইউরোপের স্থানীয় সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে না নিত। ইসলাম ও বাংলা তথা ভারতের ক্ষেত্রে এটা কম সত্য নয়। এর প্রমাণ হিসাবে তিনি উপমহাদেশের প্রথম দিককার একটি মসজিদের শিলালিপি তুলে ধরেছেন। আরবি ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় লেখা ‘এটি জগদীশ্বরের উপাসনার স্থান।’
অন্যদিকে হিন্দুধর্মেও শান্তি ও মানব কল্যাণকে উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। সন্ন্যাসী, দার্শনিক ও লেখক স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে (১৮৯৩) হিন্দুধর্মের বৈদান্তিক রূপকে বিশ্ববাসীর সামনে প্রথমে সহজ ভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই স্বীকার করি।”
তিনি বলেছিলেন “হিন্দুধর্ম দুটো জিনিস শিখিয়েছে—সহনশীলতা আর বহনশীলতা। শুধু সইব না, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াব। হিন্দুধর্ম সব ধর্মকে শুধু মেনে নেয় না—টেনেও নেয়। হিন্দুধর্ম এও শেখায় যে সর্বধর্মই সমান মহান।’
স্বামী বিবেকানন্দের সময় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল এবং এ প্রসঙ্গে তিনি বলে ছিলেন, ‘হিন্দু ধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আবার ভারতজুড়ে সব মন্দির হলেও ধর্মের কোনো উপকার হবে না। মসজিদ ভেঙে মন্দির উদ্ধার কী যুক্তিযুক্ত? কোন মসজিদের নিচে কী আছে এটা খোঁজাখুঁজি করলে মন্দিরের নিচে কী আছে অন্যদের সেটা দেখার যুক্তিটাও মানতে হয়।’
স্বামী বিবেকানন্দ একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়, প্রেম, প্রীতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। হিন্দু-মুসলমান সংহতির ক্ষেত্রে, উভয় সমাজকেই নিজের পরিচয়ের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের যুগ্ম সাধনাই ভারতবর্ষকে এক উন্নত, সুসংহত জীবনের ধারণা দিতে পারে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের উপমহাদেশে সন্ন্যাসী, দার্শনিক ও লেখক স্বামী বিবেকানন্দের মত লোকদের বাণী ও আদর্শ সুবিধাবাদীদের কারণে চাপা পড়ছে। এটা অনেক লজ্জাজনক, যখন লাশের মিছিলের সবাইকে জঙ্গি বলে উপহাস করা হয়, যেখানে নারী ও শিশুদের লাশ রয়েছে। আবার জঙ্গি তকমা দিয়ে গরিব ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের কোনো আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, দলিল বা পেপার থাকে না, তাদের ধরে এনে অন্য রাষ্ট্রে পুশইন করা হয়।
ভারতকে পারমাণবিক বোমা ফেলতে হবে সিন্দু নদীর অববাহিকায় যেখানে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। অন্য দিকে পাকিস্তানকে বোমা ফেলতে হবে দিল্লি, আগ্রাসহ প্রভৃতি স্থানে যেখানে রয়েছে মুসলিমদের বিভিন্ন নিদর্শন। অর্থাৎ উপমহাদেশের পারমাণবিক যুদ্ধ হবে আত্মঘাতী।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।’
ধর্মের নামে অধর্মবিষ, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি, সন্ত্রাস আর স্বার্থ মিশিয়ে যেন তীব্র বিষের রেসিপি তৈরি না সে বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী