images

মতামত

কল্যাণরাষ্ট্র গঠন: মুক্ত আড্ডার সুপারিশ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

০২ মে ২০২৫, ১০:০৯ এএম

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম অধ্যায়। একটি সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বদলে গেছে দেশের দৃশ্যপট। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়েই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত। দেশের ছাত্র-জনতা কোটা সংস্কারের দাবি তুলে এবং সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেন। একই সাথে গোটা দেশে বিবিধ সংস্কারের দাবি উঠে। এতে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে এবং তৎকালীন সরকারের পতন হয়। বর্তমানে সংস্কারের দাবিতে উত্তাল সমগ্র দেশ। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে সর্বক্ষেত্রে আলোচনা মুখর। মানুষ কেন সংস্কার চায় এবং সংস্কার প্রসঙ্গে সাধারণের ধারণা কীরূপ?

‘সংস্কার’ হচ্ছে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করা। যে অবস্থায় মানুষের অধিকার ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে। ‘সংস্কার’ একটি অসন্তোষজনক বা অসম সমাজ ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করার প্রক্রিয়া। সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার চলমান ধারায় পরিবর্তন ও সংশোধন ঘটে। সংস্কার হচ্ছে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা। সংস্কার একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া যা রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধনের প্রত্যয়। যার ব্যাপ্তি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধগত। যারা বঞ্চিত বা ভবিষ্যৎ বঞ্চনার আশঙ্কা করে তারা সংস্কারের নেতৃত্বে আসে। সমাজ সচেতক ও সংস্কারবাদীরা বঞ্চিত মানুষগুলো অধিকার আদায়ে সঙ্গবদ্ধ হয়। প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যার মূল লক্ষ্য বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ।

রাষ্ট্র একটি বৃহৎ সামাজিক সংগঠন। যার নেতৃত্ব প্রদান করে রাজনৈতিক দলসমূহ। একটি রাজনৈতিক দলের শক্তি হচ্ছে দলের কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই রাজনৈতিক দল ও সরকার পরিচালিত হয়। একটি রাজনৈতিক দলের দর্শন হচ্ছে জনকল্যাণ ও জাতীয় উন্নয়ন। জনগণ একটি দল বা ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে কল্যাণ ও নিরাপত্তার প্রত্যাশায়। কিন্তু কোনো দল বা ব্যক্তি যদি জন আস্থা হনন করে ভোগবাদী, দুর্বৃত্তায়ন, লুণ্ঠন ও অনাচারে লিপ্ত হয়। তবে রাষ্ট্র কাঠামোতে অরাজকতা বিরাজ করে। যে ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি স্বার্থ, দলগত স্বার্থ ও গোষ্ঠী স্বার্থ। যেখানে জনগণের অধিকার হনন হয়। এতে সংক্ষুদ্ধ হয় জনগণ। ফলে রাজনৈতিক নেতা বা দলের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তখন অধিকার হারা মানুষগুলো প্রতিবাদ ও সংগ্রাম শুরু করে। জুলাই আন্দোলন একটি সার্থক গণবিদ্রোহ। যা গণঅভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সকল পক্ষ, দল, সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান হতে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠে।

6

সমাজকল্যাণ হচ্ছে দেশের অন্যতম বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়। দেশের প্রান্তিক, অসহায়, নিগৃহীত ও বিপন্ন মানুষের কল্যাণ এ মন্ত্রণালয়ের অন্যতম কাজ। গত ২ জানুয়ারি এ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মুক্ত আড্ডা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ‘জাতীয় সমাজসেবা দিবস-২০২৫’ পালনের কর্মসূচি হিসেবে এ মুক্ত আড্ডা পরিচালিত হয়। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস এ দিবসের শুভ উদ্বোধন করেন। কল্যাণরাষ্ট্র গঠন বিষয়ক অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। যা ছিল কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং সংস্কারমূলক প্রচেষ্টার অংশ। এ অনুষ্ঠানে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে।

কল্যাণরাষ্ট্র কি? এ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পাঠকের নিকট সুস্পষ্টকরণের লক্ষ্যে এ নিবন্ধ। ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ হচ্ছে এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা: যে ব্যবস্থায় জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। এ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অক্ষমতা, বেকারত্ব, অসুস্থতা, বৈধব্য বা অন্যান্য অসহায়ত্বজনিত অবস্থায় জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করা হয়। কল্যাণরাষ্ট্র জন প্রত্যাশা অনুযায়ী কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রবর্তন করে এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিধান করে। কল্যাণরাষ্ট্রের কতিপয় সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। যথা:
ক. নাগরিকের সন্তোষজনক জীবনমান বজায় রাখা
খ. আয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমতা আনায়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা
গ. সম্পদের সুষম বণ্টন সুনিশ্চিত করা
ঘ. ভোগকারীদের একচেটিয়া ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাত থেকে রক্ষা করা
ঙ. জাতীয় আয় ও জাতীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা প্রবর্তন করা
চ. সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নতি বিধানের জন্য গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা
ছ. দেশের সকল নাগরিকের জন্য খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
জ. সকলের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

7

বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন সমাজ গঠন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ। এ মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে নীতির : সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধমূলক কাজ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, শিশুকল্যাণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে অনুদান ও কল্যাণমূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করা। তাই জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংস্কার প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় মুক্ত আড্ডা পরিচালনা করে। মুক্ত আড্ডা অনুষ্ঠানে মাননীয় সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। এ অনুষ্ঠানে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীগণ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন।

এ মুক্ত আলোচনা হতে মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে বিবিধ সুপারিশ গৃহীত হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল—
ক. কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে একটি আদর্শ সমাজকল্যাণ নীতি প্রণয়ন করা
খ. নাগরিক চাহিদা, তারুণ্যের বিকাশ ও বেকারত্ব নিরসনকল্পে কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ করা
গ. জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী আহত ও নিহতের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রবর্তন করা
ঘ. প্রবীণবান্ধব খণ্ডকালীন কর্মসংস্থান প্রকল্প প্রবর্তন
ঙ. রিকশা শ্রমিকের কল্যাণে কর্মসূচি গ্রহণ
চ. কিশোরগ্যাং নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মসূচি প্রবর্তন করা
ছ. সমাজকল্যাণমূলক কর্মকে পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান
জ. প্রতিবন্ধী বিষয়ক আইনসমূহের প্রচার-প্রসার করা এবং প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়সমূহের স্বীকৃতি ও এমপিও ভুক্তিকরণ
ঝ. নারী নির্যাতনরোধ ও শিশুসুরক্ষামূলক কর্মসূচি জোরদার করা
ঞ. জাতীয় সমাজকল্যাণ একাডেমি হিসেবে রূপান্তরকরণ
চ. নবসৃষ্ট সামাজিক সমস্যার উত্তরণ
ছ. সামাজিক সংগঠন নিবন্ধন ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনায়ন করা ইত্যাদি।

আদিকাল হতে মানুষের কল্যাণে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। মানবতাবোধ, পরস্পর মমত্ববোধ ও পরকালীন মুক্তির প্রত্যাশায় মানুষ স্বেচ্ছায় কল্যাণমূলক উদ্যোগ পরিচালনা করে থাকে। ধর্মীয় দর্শন সমাজসেবামূলক উদ্যোগের অন্যতম অনুপ্রেরণা। মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও মানুষকে কল্যাণমূলক কর্মে তাড়িত করে। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষ অভাবগ্রস্ত, দুঃখী, অসহায় ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। প্রাচীনকাল হতে এ উপমহাদেশে কল্যাণমূলক সেবাকর্ম প্রচলনের প্রমাণ মেলে। প্রাচীন ভারতবর্ষে সেবা চর্চার প্রমাণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক বুদ্ধের অনুশাসন সম্বলিত সাহিত্য ‘জটাকাস’ এ পাওয়া যায়। এ প্রাচীন সাহিত্যে ত্রিশ জন যুবক সংঘবদ্ধ হয়ে বিবিধ জনকল্যাণমূলক কর্মে আত্ম-নিয়োগের বিষয় উল্লেখ আছে।

এ অঞ্চলে ইসলামি ধর্মপ্রচারকগণ দরগাহ স্থাপন করে এবং সংলগ্ন এলাকায় কূপ স্থাপন, পুকুর খনন, ধর্মীয় জ্ঞানদান, লঙ্গরখানা স্থাপন ও অভাবগ্রস্থদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় অনেক সমাজ হিতৈষী সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হাজী মুহাম্মদ মহসীন, স্যার সৈয়দ আহমদ, রাজ রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নওয়াব আব্দুল লতিফ, রাজা রামমোহন রায়, বেগম রোকেয়া, বেগম ফয়জুন্নেসা প্রমুখ। ব্যক্তি উদ্যোগে সমাজসেবায় তাদের অসাধারণ অবদান অদ্যাবধি প্রশংসিত। আবার প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক সংকটে দুর্গত মানুষেরা রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রত্যাশী। তাই দুর্যোগ ও সংকটে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রবর্তন করা আবশ্যক।

রাষ্ট্র একটি বৃহৎ সংগঠন। জনকল্যাণের লক্ষ্যেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব। একটি আদর্শ রাষ্ট্র কাঠামোর মূল চেতনা দেশের সম্পদ ও সক্ষমতা বিবেচনায় কল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে এ উপমহাদেশ হতে ভিনদেশি শাসক গোষ্ঠীর পতন ঘটে। পরাধীন রাষ্ট্রে জনকল্যাণ ব্যবস্থা ছিল শুধুমাত্র লৌকিক। যাহা ছিল শাসক গোষ্ঠীর কর্তৃত্বমূলক শাসন স্থায়ী করার কৌশল। যাদের মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদ লুণ্ঠন, স্ব-জাতির সমৃদ্ধি ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ। কিন্তু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল চেতনা বৈষম্যহীনতা, সুশাসন, সম্পদের সুষমবন্টন ও কল্যাণরাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনের সুবাদে বর্তমানে গোটা সরকার ব্যবস্থার সংস্কার চলছে। কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কল্যাণরাষ্ট্র বিষয়ক মুক্ত আড্ডার প্রস্তাবনা যাচাই করতে হবে। অসহায় মানুষের কল্যাণে প্রয়োজনীয় চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে একটি আদর্শ সমাজকল্যাণ নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হোক আমাদের অঙ্গীকার।