images

মতামত

গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শ্রমের মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন

ঢাকা মেইল ডেস্ক

৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৫ পিএম

দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বর্তমানে আর্থিক অবস্থা বিচার করার উন্নতির অন্যতম মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২,৭৩৮ ডলার। কিন্তু বাস্তবে সব পরিবার ও সব মানুষ এই আয় করতে পারে কি না আর তাদের আয় দিয়ে সংসার চালাতে পারে কি না সেটা বিবেচনার বিষয়। 

মানুষের আর্থিক অবস্থা দেখার জন্য সব সময় সরকারি, বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান দেখারও প্রয়োজন হয় না। গ্রামগঞ্জ,  রাস্তাঘাট, ফুটপথ, হাটবাজার, পার্ক, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন প্রভৃতি স্থানের অসহায় মানুষের উপস্থিতি অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

খাদ্যদ্রব্যসহ সব পণ্যের বাজার সব সময় আগুন। যে হারে সব কিছুর দাম বাড়ে সে হারে মানুষের আয় বা বেতন বাড়ে না। বাজারে বিভিন্ন গুণগত মানের পণ্য আছে, যেমন কেউ সন্ধান করে কম দামের মোটা চাল, তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছ বা বয়লার মুরগি আবার অনেকে খোঁজে চিকন চাল ও ভাল মানের মাছ-মাংস। কিন্তু বাজারে আগুন লাগলে তার আঁচ সব পণ্যের গায়েই লাগে। সব আয়ের মানুষের একই বাজার থেকে পণ্য কিনতে হয়। আর সেই ধাক্কা সকলের কাছে সমান নয়।

নিজেদের আয়-রোজগারের সঙ্গে মিল রেখে সমাজ-সংসার রক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রতিদিন অনেক কষ্টের গল্প তৈরি হয়। দেশের অনেক মানুষের কাছে মাছ-মাংসসহ প্রাণিজ প্রোটিন সোনার হরিণ, নাগালের বাইরে।  অনেকে যথেষ্ট পরিমাণে ফল খেতে পায় না।

মধ্যবিত্তই সমাজের প্রতিনিধি। পেশা, আয়, শিক্ষা, প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সামর্থ্য এবং সামাজিক অবস্থানের দ্বারা এদের সংজ্ঞায়িত করা হয়।  অথচ এই মধ্যবিত্ত কারা এই নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কোন মাপকাঠিতে মাপা হবে, তাদের মাসিক আয় কত হবে।

বিশ্ব ব্যাংক এবং অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) রিপোর্ট অনুযায়ী, দিনে ২.১৫ ডলারের নীচে আয় করা ব্যক্তিদের গরিব শ্রেণিতে ফেলা হয় । যারা দৈনিক আড়াই ডলারের বেশি রোজগার করে তারা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’ এর মতে, দিনে ১০ থেকে ৫০ ডলার আয় করলে তাদেরকে মধ্যবিত্ত বলতে হবে । দৈনিক ৫০ ডলারের বেশি আয়ের ব্যক্তিদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বলতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮.৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তার মধ্যে অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে ৫.৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তালিকায় আমাদের অবস্থান নিচের দিকে।

২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ১৭ লাখ। এসব মানুষের পরিবারের অন্তত একজন অপুষ্টিতে ভুগছে।

এদিকে ২৪ এপ্রিল ২০২৫ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক শঙ্কা প্রকাশ করেছে চলতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৬২ জন ধনী ব্যক্তির হাতে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা বিশ্বের দরিদ্রতর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর থাকা সম্পদের সমান। ক্রেডিট সুসির তথ্য অনুযায়ী, ১ শতাংশ লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বিশ্বের বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের সমান সম্পদ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও যেন সম্পদের বড় অংশ কিছু গোষ্ঠী বা লোকের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে।  পাকিস্থান আমলে ছিল ২২ পরিবার আর এখন সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, হতে পারে কয়েক শত বা কয়েক হাজার পরিবার। বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন পরিসংখ্যান নেই কেননা আমাদের দেশে  গরিবদের নিয়ে গবেষণা হয় অথচ ধনীদের নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হয় না।

সম্প্রতি আল-জাজিরা বাংলাদেশের ধনীদের নিয়ে ‘নিখোঁজ বিলিয়নিয়ার’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং মল, খাবার থেকে শুরু করে দামি গাড়ি ও স্মার্টফোন অনেক কিছু বাংলাদেশের ধনীদের ক্রমবর্ধমান সম্পদের কথা বলে, যারা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয়। প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশানের ১৪ তলা একটি ভবনের কথা বলা হয়েছে, যেটা নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই (২০২১ সাল) প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট ২০ কোটি টাকা ভিত্তিমূলে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স জানিয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সম্পদ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় ছিল। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৫০ লাখ ডলার বা তারচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক এমন মানুষের সংখ্যা বছরে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই হার ভিয়েতানামকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টিরও বেশি বেসরকারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতিটিতে কমপক্ষে এক কোটি টাকা জমা ছিল। অথচ দেশের স্বাধীনতার পর এই ধরনের মাত্র ১৬টি অ্যাকাউন্ট ছিল এবং ২০০০ সালে ছিল তিন হাজার ৪৪২টি অ্যাকাউন্ট।

আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোটিপতিরা অফশোর অ্যাকাউন্ট এবং রিয়েল এস্টেটে তাদের সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে। প্রমাণ হিসাবে প্যান্ডোরা পেপারসে তালিকাভুক্ত ১১ জন বাংলাদেশির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

এটা অস্বীকার যাবে না, সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশের কিছু মানুষের যেন ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ দেখা দিয়েছে। তারা অঢেল ধনসম্পদ ও টাকা-পয়সার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। খুব দ্রুত সময়ে বিলনিয়ার বা পৃথিবীর অন্যতম একজন শীর্ষ ধনী হওয়ার স্বপ্নে তারা বিভোর! তাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই।

আবার অনেকে মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশে বা অন্য কোনো দেশে বসবাস করা বা আসা-যাওয়া অনেক সম্মানের ও আভিজাত্যের ব্যাপার। এ থেকে আবার প্রচলন হয়েছে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার সংস্কৃতি।

 ব্লুমবার্গ, পানামা পেপারস ও প্যান্ডোরা পেপারস, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস),  বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ন্যায় বিভিন্ন সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম বিভিন্ন সময়ে এ দেশের কিছু মানুষের অবৈধ ধনসম্পদ ও অর্থপাচারের রিপোর্ট বা খবর প্রকাশ করেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে  বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়ে ছিল। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দেড় দশক ধরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।

আমাদের দেশে সাধারণত মে দিবস উপলক্ষে মূলত সাধারণ শ্রমজীবী ও কায়িক পরিশ্রমী মানুষের কথাগুলোই প্রাধান্য পায়।  শিক্ষিত পেশাজীবীদের একটি বড় অংশের সংসার জীবনের গল্পগুলো সবসময় অগোচরে থেকে যায়।

সাধারণ শ্রমজীবী, কায়িক পরিশ্রমী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএস, টিসিবি কার্ডসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ও ভাতা। তার যে সবসময় ভালো থাকে সেটা বলা যায় না, তবে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে কোনো মতে জীবন পার করতে পারে। কিন্তু দেশের অনেক লোক সামাজিক মান সম্মানের কারণে পণ্য কেনার জন্য ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানোসহ বিভিন্ন  স্থানে যেতে পারে না।  যে কারণে অনেক সময় তাদের পরিবার নিয়ে কষ্টে  থাকতে হয়।

এ সব  শিক্ষিত পেশাজীবী শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী,  মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতসহ অনেক।

দেশে প্রায় ছয় লাখের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছে। একজন সাধারণ শিক্ষক স্কুল বা মাদ্রাসায় যোগদান করার শুরুতে সর্বমোট বেতন পান ১২,৭৫০ টাকা। বিএড থাকলে আরও ২/৩ হাজার বেশি। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি পায় এবং একজন সাধারণ শিক্ষকের অবসরের সময় বেতন দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার টাকা। ঈদ উৎসব ভাতা শিক্ষকরা পায় বেতনের ২৫ শতাংশ।

পাঠ্যক্রম সিলেবাস, আইন এবং একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হলেও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সুযোগ-সুবিধা কম।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেও শুধু মাত্র শিক্ষাকতা পেশায় আসার কারণে এই বঞ্চনার শিকার। দেশের মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৭ ভাগ এমপিওভুক্ত আওতায় চলে।  মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ আমাদের দেশে চরম অবহেলিত। ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী, একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে জিডিপির মাত্র ১.৭ শতাংশ  শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল।

শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হয়েছে কিন্তু তাদের দাবি বাস্তবায়ন হয়নি । বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের উৎসব বোনাস ২৫% থেকে ৫০% বৃদ্ধিসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

সারা দেশে এমন অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। অনেকগুলো আবার সরকারি ভাতা পাওয়ার ও এমপিওভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেখানকার শিক্ষকরা নামমাত্র সামান্য কিছু বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন, অনেকে আবার কিছুই পান না। ঢাকা শহরে  অনেক বেসরকারি স্কুল আছে, যারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাত উল্লেখ করে বড় অঙ্কের টাকা নেয় কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থাটা উল্টো।

RR

বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও  কোম্পানিতে  চাকরিরত অনেকের  অবস্থা প্রায় একই রকম। কিছু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছাড়া অধিকাংশই বেতন কাঠামো ও নিয়মনীতি অনুসরণ করে না। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী মনিটারিং না থাকায় তারা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরী পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এটা কেউ না মানায় তাদের জীবন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

দেশে অসংখ্য  নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রয়েছে। কিছু  বিদেশি এনজিও ছাড়া অন্যদের পরিশ্রমের তুলনায় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম। প্রজেক্ট ভিত্তিক কর্মীরা প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।  আদর্শগতভাবে অনেক এনজিও কোনো ব্যবসায়িক লাভের জন্য কাজ করে না। তাই অনেকের লক্ষ্য থাকে কর্মীদের যত কম বেতন দিয়ে অবশিষ্ট অর্থ উন্নয়নের কাজে লাগানো যায়।

আমাদের দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো সুন্দর মসজিদ নির্মাণের জন্য তারা অনেক অর্থ দান করেন তবে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের স্বচ্ছলে চলার মতো অর্থ দিতে তারা রাজি নয়। মসজিদের ইমামরা সমাজের সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত অথচ তাদের বেতন এক অর্থে অসম্মানের। অভাব-অনটন সবসময় লেগেই থাকে। বাসা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে থাকার সামর্থ্য থাকেনা। অধিকাংশের মসজিদ লাগোয়া একটি ছোট্ট ঘর অথবা মসজিদেই জীবন চলে। দুটি লুঙ্গি, একটি পাজামা আর দুটি পাঞ্জাবিতে বছর পার।

রাজধানীতে গড়পড়তা ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাসিক বেতন  ৫  থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। অন্যদিকে গ্রাম বা মফস্বলের ইমামদের বেতন ২ থকে ৫ হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মসজিদ কমিটি সময় মতো চাঁদা আদায় করতে না পারলে পুরো বেতনটাও সময়মত পাওয়া যায় না। গ্রামের কোনো কোনো মসজিদে বছরে মৌসুমভিত্তিক ধান বা অন্যান্য ফসল বা টাকা তুলে দেওয়া হয়। প্রায় একইভাবে অসহায় হয়ে পড়ছে হিন্দুদের পুরোহিত সমাজ।

২০০৬ সালে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ প্রণয়ন করলেও বাধ্যবাধকতা না থাকায় অধিকাংশ মসজিদ কমিটি এসব কোন নিয়ম মানে না।

সাংবাদিকরা সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম ও অসঙ্গতি তুলে ধরে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। অথচ পেশা বা চাকরি, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অবস্থা একেবারে তলানিতে।

সারাদেশে নিবন্ধিত পত্রিকার (প্রিন্ট মিডিয়া) সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি । রয়েছে অনেক টিভি চ্যানেল। অনলাইন মিডিয়ার সম্ভবনার কারণে দেশে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালের উদয় হয়েছে।  যাদের আবার অধিকাংশের নিবন্ধন নেই।

দীর্ঘকাল ধরে মিডিয়া জগতে এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা। কে বা কারা রেজিস্ট্রেশন, নিবন্ধন ও অনুমোদন নিচ্ছে বা নেওয়ার পর কি করছে তা জানার বা দেখার প্রয়োজনীয়তা যেন কেউ অনুভব করছে না। যে কারণে প্রকৃত সংবাদকর্মীরা চাপা পড়ছে।

সামাজিক প্রেক্ষাপট, অব্যাহত অনিয়ম ও মালিক পক্ষের সুযোগ সন্ধানী নীতির কারণে সাংবাদিকের হাহাকার বেড়েই চলেছে। এই অবস্থার মধ্যে সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নের জন্য কেউ কোন পদক্ষেপ নিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন হওয়ার কথা সরকার ঘোষিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। সেই অনুযায়ী সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যও নির্ধারণ হয়। বর্তমানে চলছে নবম ওয়েজ বোর্ড। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা, আর কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন করে, অন্যগুলো ধারে কাছে নেই। অনেকে সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে বলে “তোমার বেতন, তুমি সংগ্রহ করো।”

বাজারে চালু অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি সাংবাদিকের নিয়মত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, বাকিগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বর্তমানে সংবাদপত্রের সার্কুলেশন নেই বললে চলে, পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে, অথচ এখনও পর্যন্ত সরকার অনলাইনের জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি।

 অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকদের আইডি কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুব সামান্য সংখ্যক সাংবাদিকদের সামান্য পরিমাণে টাকা দেওয়া হয় যেটা তাদের যাতায়াত, ইন্টারনেট ও মোবাইলের পিছুনে খরচ হয়ে যায়। সারাজীবন চাকরি করার পর অধিকাংশ সাংবাদিককে প্রায় খালি হাতে বাড়ি চলে যেতে হয়। নাই কোনো পেনশন সুবিধা।

এমন অবস্থায় দেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।  অনেক সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, বাহিনীর কর্মকর্তারা এন্ট্রি লেবেল থেকে তাদের ন্যায্য পাওনা পায় অথচ অসংখ্য মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে বৈষম্যের শিকার।

২০২৫ সালের শ্রীলঙ্কার বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের মাসিক ন্যূনতম মূল বেতন ২৪,২৫০ রুপি থেকে ৪০,০০০ রুপিতে উন্নীত করা হয়েছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ২১,০০০ রুপি থেকে বাড়িয়ে ২৭,০০০ রুপি করা হয়েছে । ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে এটি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৩০,০০০ রুপি হবে। দৈনিক মজুরি ৭০০ রুপি থেকে বাড়িয়ে ১,০৮০ রুপি করা হয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে এই ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১,২০০ রুপি করার পরিকল্পনা রয়েছে। চা, রাবার ও নারকেল  বাগানের  শ্রমিকদের  তাদের দৈনিক মজুরি ১,৭০০ রুপিতে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ভারত সরকার চলতি ২০২৫ সালের বাজেটে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত করছে।  আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলো যদি পদক্ষেপ নিয়ে সফলতা পায়, সে ক্ষেত্রে আমরা কেন পারবো না?

গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় বিচাররের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ ও সুষম বণ্টনই কমাতে পারে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য আর নিপীড়ন। কৃষি, শিল্প বা সেবাসহ সব খাতে যারা শ্রমদান করে তাদের জন্য স্থিতিশীল এবং ভাল আয় নিশ্চিত হোক মে দিবসের দাবি ।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী