images

মতামত

স্তন ক্যান্সার নিরাময়ে চাই সচেতনতা

২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৬ পিএম

দিন দিন অসংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা বেড়েই চলছে। ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সার শব্দটি শুনলেই সবাই আঁতকে ওঠেন। একসময় মনে করা হতো, ক্যান্সারের কোন এন্সার (উত্তর) নেই। একবার ক্যান্সার হওয়া মানেই ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু এখন এই ধারণা একেবারেই অমূলক। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যান্সার মানে অবধারিত মৃত্যু নয়। ক্যান্সারের চিকিৎসাও আর অজেয় নয়। শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এ রোগের  চিকিৎসা, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। সমস্যা দেখা দেয় অধিকাংশ আক্রান্ত নারীরা যথাযথ সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় না। তাছাড়া সামাজিক বিধি নিষেধ, লোক লজ্জা এবং সচেতনতার অভাব সব মিলিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যেতে অনেক দেরি করে। এমনও দেখা যায় যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে, সেই সময় রোগটি স্তনের বাইরে বগলে বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় চিকিৎসার খরচ যেমন বেড়ে যায়, রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

নারীদের সবচেয়ে বেশি হওয়া ক্যান্সার গুলোর একটি ব্রেস্ট ক্যানসার বা স্তন ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে স্তন ক্যানসারে মারা গেছেন ৬ লাখ ৭০ হাজার নারী। স্তন ক্যান্সার আসলে নারীদের রোগ, তবে অনেক সময় পুরুষদেরও স্তন্য ক্যান্সার হতে পারে, একটা রোগে হয় তাকে বলে ক্লাইনে ফেল্টার্স সিনড্রোম। ০.৫ থেকে ১ শতাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্তন ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীদের মধ্যেও এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। প্রতিবছর বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ১৩–১৪ হাজার নারী এবং মারা যান প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার নারী। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার দ্রুত সনাক্ত এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ ক্যান্সার আক্রান্ত শতভাগ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। জনসাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে প্রতিবছর অক্টোবর জুড়ে বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ১০ অক্টোবর বিশ্ব স্তন ক্যান্সার দিবস বিশেষভাবে পালন করা হয়। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘স্ক্রীনিং জীবন বাঁচায়’। জনগণের মধ্যে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ এসব কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। এ জন্য রয়েছে বেশ কিছু উপায়।

স্তন ক্যান্সারের কারণ: নির্দিষ্টভাবে কোনো কারণ জানা না থাকলেও কিছু কিছু ফ্যাক্টর ক্যান্সারের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়, যেমন –

১. বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ করে ৫৫ বছরের বেশি বয়স হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২. লাইফস্টাইল ফ্যাক্টর: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান, দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস এবং ব্যায়াম বা হাঁটাচলা একেবারেই না করা, অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে যুক্ত।

৩. স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস অন্যতম কারণ।

৪. হরমোনাল ফ্যাক্টর: হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, কম বয়সে মাসিক চক্র আরম্ভ বা তাড়াতাড়ি ঋতুস্রাব এবং দেরীতে মেনোপজ স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৫. জীবনে বাচ্চা না নেয়া বা কখনও গর্ভবতী হয় নাই বা অধিক বয়সে শিশু জন্ম দেওয়া যেমন ৩০ বছর বয়সের পরে যাদের প্রথম সন্তান হয়েছে, বা যারা বুকের দুধ পান করাননি তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। বিপরীতভাবে একাধিক গর্ভাবস্থা এবং বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

৬. বিকিরণের প্রভাব: যে মহিলারা বুকের এলাকায় অন্য ক্যান্সারের কারণে বিশেষ করে মাথা, ঘাড় বা বুকে রেডিওথেরাপি নিয়েছেন, বিশেষ করে অল্প বয়সে, তাদের পরবর্তী জীবনে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

লক্ষণ: স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিন্ডে পরিণত হয়, আর তাই রূপ নেয় ক্যান্সারে। নিম্নে কিছু লক্ষণ দেওয়া হলো যেগুলো দেখা দিলে ক্যান্সারের ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে।

১. স্তনে চাকা বা পিণ্ড, স্তনের ভিতরে গোটা ওঠা বা শক্ত হয়ে যাওয়া এবং স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন।

২. নিপল বা বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া, অসমান বা বাঁকা হওয়া অথবা উল্টানো স্তনবৃন্ত, যা আগে উল্টানো ছিল না।

৩. স্তনবৃন্তের চারপাশে বা স্তনের কোথাও গাঢ় পিগমেন্টেশন বা ফ্লেকিং এবং ত্বকের খোসা দেখা দিলে।

৪. নিপল বা স্তনবৃন্ত দিয়ে অস্বাভাবিক রস বা রক্তক্ষরণ হওয়া।

৫. স্তনের চামড়ার রং বা চেহারায় পরিবর্তন এবং  ডিম্পলিং, বিভিন্ন দিকে বেঁকে যাওয়া।

৬. ডান বা বাম স্তনের পাশের বগলতলায় পিণ্ড বা চাকা দেখা দিলে।

পরীক্ষা: দুটি উপায়ে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। কোনো লক্ষণ টের পেলে জরুরিভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো উচিত। আবার যাদের মধ্যে লক্ষণ নেই, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে থেকে রোগী শনাক্ত করা উচিত।

ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এগজামিনেশন: চিকিৎসক বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে স্তন পরীক্ষা করাকে ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশন বলে। চিকিৎসক স্তন ও বগলতলায় কোনো চাকা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন আছে কি না তা সুনির্দিষ্ট নিয়মে সযত্নে পরীক্ষা করে দেখেন।

নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা: একজন নারী নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে যদি নিয়মিত নিজের স্তন ভালোভাবে পরীক্ষা করেন তাহলে যেকোনো ধরনের অসামঞ্জস্য বা পরিবর্তন নিজেই প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন। সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

চিকিৎসা: স্তন ক্যানসারের স্টেজ ও ধরনের ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি স্তন ক্যানসার নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসার কোষ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হলে তা আবার ফিরে আসতে পারে। তাই নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত।

মনে রাখুন, স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব, নিম্নে কিছু টিপস দেওয়া হলো:

১. ৩০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন পরীক্ষা করুন। ৪০ বা ৫০ বৎসর মহিলাদের প্রতি বছর আলট্রাসনোগ্রাম এবং মেমোগ্রাম করা উচিত।

২. অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন আপনার কাছে ধরা পড়লে অবহেলা না করে চিকিৎসক বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে স্তন পরীক্ষা করান।

৩. চিকিৎসক যদি কোনো চাকা বা পিণ্ড বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন শনাক্ত করেন, তাহলে তাঁর পরামর্শে মেমোগ্রাম, স্তনের আলট্রাসনোগ্রাম, বায়োপসি ও টিস্যু পরীক্ষা বা অন্য পরীক্ষাগুলো করানো উচিত।

৪. প্রতিরোধের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান বর্জন এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল অবশ্যই পরিহার করতে হবে। বাচ্চাকে অবশ্যই বুকের দুধ পান করাতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যান্সার মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়। একটু সচেতন হলেই ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে যদি চিকিৎসা করানো যায় তাহলে এই রোগ থেকে শতভাগ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদি ক্যান্সার হয়েও যায় তবুও শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে তার ভালো চিকিৎসা করা যায়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। তাই স্তন ক্যান্সার নামক এই বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ