০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৫০ পিএম
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে একটি জটিল সমীকরণ কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও মতভেদ দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটানা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বলছে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রেখেছে। কিন্তু দুর্নীতি, অনৈতিকতা এবং স্বৈরশাসনের মাত্রা যখন সীমালঙ্ঘন করেছিল, তখন শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে আওয়ামী স্বৈরশাসনের পতন ঘটানো সম্ভব হলেও বর্তমান দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের পতন ঘটানো যেমন সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের উপযোগী পরিস্থিতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। এমন একটি চ্যালেঞ্জের সময় অন্তবর্তীকালীন সরকার চাপের মুখে পড়েছে। অনেকে মনে করছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ নির্বাচন, আবার কেউ কেউ ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে উপদেশ দিচ্ছেন।
দেশের রাজনৈতিক ময়দানে যেসব প্রশ্ন আজ প্রধান হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি তর্কের জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এই অন্তবর্তীকালীন সরকার কেবল একটি ছদ্মবেশ; আড়ালে থেকে আসল ক্ষমতাধররা কলকাঠি নাড়ছেন। এই সমীকরণে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা তলানিতে ঠেকতে শুরু করেছে। জনগণের ধারণা, তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা হবে।
বর্তমানে বিএনপি অতীতের ক্ষোভ মেটাতে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু জামায়াতের তেমন তাড়া নেই। কেন? কারণ, জামায়াত বহু বছর ধরে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি পাওয়া সত্ত্বেও তাদের রাজনীতির পথ অন্যরকম। এই ‘জঙ্গি’ তকমা আসলে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল এবং ভারতকে খুশি রাখার একটি কৌশল।
বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম, এবং তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করতে চায়। দেশের প্রশাসনের ভেতরে জামায়াতের সুসংহত অবস্থান রয়েছে, যা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। জামায়াত বুদ্ধি এবং কৌশলগত রাজনীতি করলেও জনসমর্থন নিয়ে সরাসরি ক্ষমতায় আসা তাদের জন্য এতদিন কঠিন ছিল। তাই তারা জনসমর্থন ছাড়াই কিছুটা কৌশলগতভাবে ক্ষমতার বলয়ে থাকতে চাইছে এবং সেই কারণেই তারা এখন নির্বাচনে তেমন তাড়া দেখাচ্ছে না।
তবে এটা মনে করা অস্বাভাবিক নয় যে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির বহু আগেই কোটা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সফলতা দেখে তারা এবার এই আন্দোলনকে সরকার পতনের পূর্বাপর একটি সুযোগ হিসেবে ধরছে। সাধারণ ছাত্রের ছদ্মবেশে তারা নানা রকম শক্তিকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে— কোটা বিরোধী মনোভাব, বিএনপির ক্ষমতায় আসার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ইসলামী দলগুলোর আওয়ামী বিরোধিতা এবং আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা।
গণমাধ্যমের সূত্রে এমনটিও জানা গেছে যে সেনাপ্রশাসনের সঙ্গে জামায়াতের চালটি বেশ কৌশলী ছিল। সেনাপ্রশাসন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছিল, যেখানে সেনাপ্রশাসন পেছন থেকে দেশ পরিচালনা করবে বলে আশাবাদী ছিল। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত কৌশলী চালের শিকার হয়। শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে সেনাপ্রশাসন একটি কৃত্রিম বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি করে। কিন্তু যখন সেনাপ্রশাসন শিবিরের সমন্বয়কদের কাছ থেকে শুনল তারা সেনাসমর্থিত সরকার চায় না, বরং তারা নিজেরাই সরকারের রূপরেখা তৈরি করবে— তখন সেনাপ্রশাসন সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়।
সেনাপ্রশাসন সেই ধাক্কা সামলাতে পারেনি এবং তারপর থেকেই সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এর ফলে দেশে বিশৃঙ্খলা এবং লুটপাট বাড়ছে। জামায়াত তাদের কৌশলগত অবস্থানকে আরও মজবুত করতে আমেরিকার সমর্থনে ড. ইউনূসকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের ধারণা, তারা আমেরিকাকে বোকা বানাতে পেরেছে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, আমেরিকা মনে করছে তারা ইউনূসের মাধ্যমে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
এদিকে বিএনপি গত সতেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগের হাতে মার খেয়ে এবার নিজের দোসর জামায়াতের কাছেও মার খাচ্ছে। অন্যদিকে, ইসলামী দলগুলো জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে।
জামায়াত আপাতত সরাসরি নির্বাচন চায় না। তাদের লক্ষ্য হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে কৌশলের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে যাওয়া। এর মানে হলো, তারা সাংবিধানিক নির্বাচনের পথে না হেঁটে, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে।
অনেকের ধারণা জামায়াতের বিপ্লব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এটি আসলে তাদের গোপন বিপ্লবের প্রথম ধাপ মাত্র। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আরও অনেক ধাপ বাকি রয়েছে। জামায়াতের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো, ক্ষমতার আড়ালে থেকে ক্ষমতা চালানো।
তবে জামায়াতের নেতাকর্মীরা সবসময় বলে থাকে তারা ক্ষমতার রাজনীতি করে না, কিন্তু বাস্তবে তারা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের মতোই ক্ষমতার রাজনীতিই করে। এতদিন যারা বলেছেন, ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত জয়ী হতে পারবে না, তাদের ধারণা পাল্টানোর সময় এসেছে। জামায়াত এখন তার ইসলামী মিত্রদের নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে।
সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে জামায়াত আপাতত সরাসরি নির্বাচন চায় না। তাদের লক্ষ্য হলো কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকেই তাদের অবস্থান দৃঢ় করা। অন্যদিকে, আমেরিকার উদ্দেশ্য হলো, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে কোনো সময় জঙ্গিবাদের উত্থান হলে তা দমনের অজুহাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা এবং সেন্টমার্টিনে অবস্থান নেওয়া।
এত কিছুর পরও রাজনৈতিক দল বিএনপি বর্তমানে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা অতীতের ব্যর্থতা এবং ক্ষোভ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কৌশল সাজাচ্ছে। অন্যদিকে, আরেকটি দল বা গোষ্ঠী, যারা দীর্ঘদিন ধরে ‘উগ্রবাদী’ বা ‘জঙ্গি’ তকমা নিয়ে রাজনীতি করে এসেছে, তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য, জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করে রাজনীতির চালগুলো চালিয়ে যাওয়া।
এই অবস্থায় তারা কেন নির্বাচন চায় বা না চায়, সে প্রশ্ন আসলে অবান্তর। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অতীতের স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে এবং দুর্নীতির শিকার হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে একাধিক অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে, যারা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন এবং দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এর ফলে, তাদের মধ্যে একটি মানসিক সংকোচ এবং ভীতি কাজ করছে, যা তাদের নিরপেক্ষতা এবং দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেকেই মনে করেন, এই কর্মকর্তারা সাবেক ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাদের পূর্বের সম্পর্ক এবং নিজস্ব অবস্থান রক্ষায় অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন, যা দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের একটি বড় কারণ।
প্রশাসনের এমন ভূমিকা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা গেছে। ২০২০ সালে রোহিঙ্গা জনগণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের অপ্রতুল পদক্ষেপ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। এতে করে দেশজুড়ে এক ধরনের শঙ্কা এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এখানে কৌশলী নীরবতা যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণ মেলানোর প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা।
নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তি অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনটিও জানা গেছে যে ২০১৭ সালের আগস্টে, নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা একটি গোপন বৈঠকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতার ধারণার পরিকল্পনা করেন, যা জনগণের উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদের মুখে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল, তারা ছাড়া দেশ চালানো সম্ভব নয়, কিন্তু বাস্তবতা তাদের বিপরীত পথে পরিচালিত করেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জগুলো কম নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতির কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়েছে। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি এবং তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব দেশীয় অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যদিও অনেকেই সরকারের নানা পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন, তবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। দেশের জনগণ দুর্নীতিমুক্ত এবং ক্যাশলেস লেনদেনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে চায়, যেখানে তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
অনেকে মনে করেন, যে ‘বিপ্লব’ এখন শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তা আসলে শুরু মাত্র। গোপন রাজনৈতিক চাল এবং ক্ষমতার লড়াই এখনও চলছে। দেশের জনগণ একটি স্থিতিশীল পরিবেশে বসবাস করতে চায়, যেখানে তারা তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে এবং যেখানে প্রশাসন জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। তবে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতা কেবল সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাগুলোকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
এত কিছু লিখার পর, আমার দেখা বাংলাদেশ ১৯৭১-২০২৪— দেশটিতে সেই শুরু থেকে চলছে ‘ধর মারো খাও’ রাজনীতি। ক্ষমতাচ্যুত, নতুনের ক্ষমতা, পালানোর তুফান, বছরের পর বছর ধরে তদন্ত কমিটি গঠন, কোর্ট-কাচারি, জেলহাজত, নির্বাচন, নতুন দলের ক্ষমতা দখল ইত্যাদি।
বলি, দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা কবে গড়ব, সেটা কি কেউ ভেবেছে?
বাংলাদেশ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি প্রতিটি স্তরে উচ্চারিত হচ্ছে। জনগণ দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, এবং শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপনের আশায় দিন গুনছে। কে ক্ষমতায় থাকবে বা কে ক্ষমতায় আসবে, তা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সুশাসন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
আমাদের মূল চাওয়া হলো ক্যাশলেস একটি বাংলাদেশ, যেখানে দুর্নীতি থাকবে না এবং যেখানে প্রত্যেকে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এটাই বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের সবচেয়ে কাম্য।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com