images

মতামত

শাসকের দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের বিপদ 

২১ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৫২ পিএম

শাসকের দম্ভ, অহংকার ও ঔদ্ধত্য তাকে দেশ, জনগণ, এমনকি তার আশপাশের মানুষের জন্যও যে সর্বনাশা ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে তা বাঙালি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে এবং করছে। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট (২০২৪) পর্যন্ত মাত্র ২১ দিনে গণমাধ্যমের হিসাবে পাঁচ শতাধিক এবং বেসরকারি হিসাবে সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যার পরও শাসকের এ তাণ্ডবের অবসান ঘটত না, যদি না আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বেঘোরে প্রাণ হারাতে শুরু করতো। মানুষের জীবনের মূল্য না বুঝলেও শেখ হাসিনা নিজের জীবনকে ‘অমূল্য’ ভেবেছেন এবং তার অনুগত দাসানুদাসদের তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে অবশিষ্ট জীবন বেঁচে থাকার আশায় পালিয়েছেন। 

কবি জন কিটস তার ‘ওড টু এ নাইটিংগেল’ কবিতায় বলেছেন— দাম্ভিকতা মানুষকে আত্মগর্বে অন্ধ করে ফেলে, বিষণ্নতায় ঠেলে দেয়। তার মাঝ থেকে নম্রতা, শালীনতা ও ভব্যতার গুণ হারিয়ে যায়। তিনি যা বলেন তা পরিণত হয় অহংকারের প্রলাপে। অনিয়ন্ত্রিত অহংকার তাকে শ্রেষ্ঠত্বের বিপজ্জনক অনুভূতিতে জাপটে ধরে এবং বেলুনের মতো স্ফীত হতে থাকে। কবি পার্সি শেলি তার এক কবিতায় এই বিভ্রম বা মনোবৈকল্যকে এক সময়ের পরাক্রমশালী শাসকের উপড়ে ফেলা মূর্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা ছিল সেই শাসকের অহংকার এবং ক্ষমতার ক্ষণস্থায়ী বৈশিষ্টের প্রমাণ। কবি লিখেছেন: “Look on my Works, ye Mighty, and despair!”  (আমার কাজগুলো দেখো, হে পরাক্রমশালী এবং আমার হতাশা দেখো!" শাসকের অহংকারের পরিণতি ছিল কারণ তার সাম্রাজ্যের ধ্বংস।

কবি উইলিয়াম আর্নেস্ট হেনলি তার ‘ইনভিকটাস’ কবিতায় শাসকের আত্মকেন্দ্রিকতা ও অতি ঔদ্ধত্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। কবিতার শেষ লাইনটি হচ্ছে: “I am the master of my fate, I am the captain of my soul.” (আমিই আমার ভাগ্য নিয়ন্তা, আমিই আমার আত্মার পরিচালক)। একপর্যায়ে শাসক নিজেকে এত শক্তিশালী ভাবতে শুরুর করেন যে তিনি যেকোনো প্রতিকূলতার ঊর্ধ্বে। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। তিনি তাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন কোনো প্রতিপক্ষ দেখেননি। দৃশ্যমান সকল প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে তিনি তার চারপাশে গড়ে তুলেছিলেন সীমাহীন দম্ভের বলয়। কবি টি এস এলিয়টও একইভাবে তার ’দ্য লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রোক’ এ বলেছেন— অহংকারী ব্যক্তি ভাবতে অক্ষম যে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তার মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। কিন্তু অহংকার ও দম্ভ কাটিয়ে উঠতে পারেন না। তার কবিতার একটি লাইন হলো: “Do I dare disturb the universe? (আমি কি বিশ্বকে উৎপীড়ন করার সাহস করি?) তিনি আত্ম-অহংকারে আচ্ছন্ন, তার বিশ্বাস তার কাজের পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী। শেষ পর্যন্ত তার অহং বোধের কাছে পরাভূত হতে চান না। কিন্তু পরাজিত হতেই হয়। দুঃশাসনের অনিবার্য পরিণতি পরাজয় ও পলায়ন এবং অদৃষ্ট মন্দ হলে জনরোষে মৃত্যু। 

শেখ হাসিনা বিশ্বে পরাজয় ও পলায়নের একমাত্র দৃষ্টান্ত নন। বিশ্বের সকল স্বৈরশাসকের পতনের কারণগুলো অভিন্ন—অহংকার, আমিত্বের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য। শেখ হাসিনা পালিয়ে বেঁচে গেলেও কার্যত তিনি মৃত। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও তিনি পূজিত হতেন প্রাচীন চীনের ঝাউ রাজবংশের প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী সম্রাজ্ঞী ‘উ সেটিয়ানের (Wu Zetian) মতো। দিবানিশি তার পদস্পর্শ ও পদচুম্বন করতো রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে তার সকল আশির্বাদপুষ্টরা, আজ কেউ তার পাশে নেই। একদিন যারা তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন, এখন তারা সেই ছবি ধ্বংস করছেন, লুকিয়ে ফেলছেন। যার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি তুলতে ভয় করতেন, তারা তার বিরুদ্ধে শত অভিযোগ দাঁড় করাচ্ছেন। হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতির অভিযোগে একের পর এক মামলা দায়ের করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে। অবশিষ্ট জীবন দুর্বিষহ করে রাখার জন্য এসবই যথেষ্ট। কবি ইকবাল বলেছেন:    

‘ইয়ে কবর, ইয়ে কাফন ইয়ে জানাজে রসমে শরিয়ত থি ইকবাল, মর তো ইনসান তবহি জাতা হ্যায় জব উসসে কোঈ ইয়াদ করনে ওয়ালা না হো।’
(ইকবাল, এই যে কবর, কাফন, জানাজা—সবই তো শরিয়তের নিয়ম, মানুষ তো তখনই মরে যায়, যখন তাকে স্মরণ করার কেউ থাকে না।)

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বয়স ৭৬ বছর। বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ৭২ বছরের চেয়ে বেশি। আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং আশা করি তিনি আরও দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন। জনপ্রিয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তিনি ও তার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলেও তিনি ও তার দলের যেহেতু এখনো বিশ্বাস যে, বাংলাদেশ মানেই তার মরহুম পিতা, তিনি এবং তার দল। যারা তাদেরকে উৎখাত করেছে তারা স্বাধীনতাবিরোধী, বিভ্রান্ত কোমলমতি ছাত্র, দেশ ও জনগণের শত্রু, দেশ শাসন ও শোষণ-লুণ্ঠনের অধিকার শুধু তার ও তার দল আওয়ামী লীগের, অতএব তারা সোজা বা বাঁকা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চেষ্টা করতে পারেন। তবে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে তিনি এমনও ভাবতে পারেন: 

‘আব তো না শওক, না তামান্না, না কোঈ আরজু বাকি হ্যায়, আব তো বাস জিন্দেগি গুজার জায়ে, বাস ইতনা হি কাফি হ্যায়।’
(এখন আর কোনো আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং ইচ্ছা অবশিষ্ট নেই, যদি কেবল জীবনটা কোনোমতে কেটে যায়, সেটুকুই যথেষ্ট।)

কিন্তু পরাজয় ও পলায়নের গ্লানিতে তার হৃদয় ভরপুর, সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষতের। তার আপন-পর সবাই তার অন্যায়ের ফিরিস্তি নিয়ে হাজির, যেন তারাই দুই কাঁধে বসে থাকা ফেরেশতা কিরামান ও কাতিবিন। শেখ হাসিনা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছেন, ক’দিন আগেও যারা তার পাশে দাঁড়িয়ে তার সকল কাজে ও সিদ্ধান্তে জয়ধ্বনি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, যারা এতদিন তার দ্বারা নানাভাবে উপকৃত হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে যাওয়ার সাথে সাথে তারা বলতে শুধু করেছে, ‘আমরা মুখ খুলতে পারিনি, কারণ আমাদের ঘাড়ে দুটি মাথা ছিল না।’ বিপদে পড়লে কেউ আর আপন থাকে না। বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যার পর যখন তার মৃতদেহ হাতির পিঠে তুলে মুর্শিদাবাদের রাস্তা প্রদক্ষিণ করা হচ্ছিল, তখন মুর্শিদাবাদবাসী রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবিত অস্তিত্বও এখন তামাশায় পরিণত হয়েছে। ভালো মন্দ সকল ধরনের শাসকের পতনে এমন হয়। শেখ হাসিনা এখন কার কাছে তার দুঃখের কথা বলবেন। কবি বলেছেন: 

‘মুটঠিয়ো মে লিয়ে নমক লিয়ে ফিরতে হ্যায় আজ কে লোগ, আপনে জখম কো কিসি হাল দিখায়া না কারো।’
(এখন লোকজন হাতের মুঠিতে লবণ নিয়ে ঘুরছে, নিজের ক্ষত কিছুতেই কাউকে দেখানো উচিত নয়।)

কোনো স্বৈরাচারী শাসক, যিনি তার দেশের জনগণের ওপর বিভীষিকাময় শাসন চাপিয়েছিলেন, খুন, গুম, আটক, নির্দয় আচরণে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিলেন, তিনি কি নিজের অপমানজনক পরিণতির কারণে জীবনের কোনো পর্যায়ে অনুশোচনা করে বলবেন:  

‘হামনে এ্যয়সি ভি কিয়া খাতা কর দি জো কাবিলে মাফি নেহি, তুমহে দেখা নেহি মুদ্দতো সে কিয়া ইতনি সাজা কাফি নেহি?
(আমি এমন কি অন্যায় করেছি, যা ক্ষমা লাভের উপযুক্ত নয়, তোমাদের কতকাল দেখতে পাই না, এই শাস্তি কি যথেষ্ট নয়?)

শেখ হাসিনা বারবার যেভাবেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকুন না কেন, প্রতিবার তাকে ‘অনুরাগ বা বিরাগ’ এর ঊর্ধ্বে থাকার শপথ গ্রহণ করতে হয়েছে। প্রতিবার তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন; কারণ পরিবার ও দলের লোকদের প্রতি তার ‘অনুরাগ’ উথলে পড়েছে, আর প্রতিপক্ষের প্রতি চরম ‘বিরাগ’ ছাড়া আর কিছুই পোষণ করেননি। তার বিরাগে কত পরিবার উজাড় হয়েছে, কারও প্রতি সামান্য সন্দেহে অথবা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কারণে তাদেরকে ধরে এনে বিনাবিচারে তার সৃষ্ট আবদ্ধ আলোবাতাসহীন ‘আয়নাঘরে’ বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে, যারা প্রতিটি দিন তাদের জীবনের শেষ দিন বলে মনে করেছে। এইসব নিপীড়িতের অভিশাপ, বদদোয়া কোনো সময় যদি তার ওপর একইভাবে আপতিত হয়, তখন তার অবস্থা হবে তার দ্বারা নিগৃহীতের মতো। মৃত্যু কাছে আসবে, কিন্তু মৃত্যু ঘটবে না। তিনি ভাববেন:

‘মওত ভি মেরে পাস আকর রোতি হ্যায় আউর কেহতি হ্যায়, তুমহে কিয়া মারু তু তো হর রোজ মরতি হ্যায়।’
(মৃত্যুও আমার কাছে এসে কেঁদে কেঁদে বলে, তোমাকে মেরে কি হবে, তুমি তো প্রতিদিন মরছো।)