images

মতামত

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ঐতিহাসিক 

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১০ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৪ এএম

বিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে বাংলায়ও এসেছিলেন। তৎকালীন রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন ও সমতটের আলোকে তিনি বাংলার সমৃদ্ধির কথা বলে গেছেন। তিনি এ দেশটিকে ঘন বসতিপূর্ণ এবং সবধরনের খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ দেখতে পান। এদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাপ্ত সুস্বাদু ‘পানাসা ফল’ (কাঁঠাল) বিশেষভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানকার মানুষ বিদ্যার কদর করে।

সমতল প্রসঙ্গে বলেছেন, নিম্নভূমির এ দেশটি সমৃদ্ধ। এখানে জমি নিয়মিত চাষাবাদ করা হয় এবং পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদিত হয়। এর আবহাওয়া নমনীয় এবং অধিবাসীদের আচরণ অমায়িক। এরা প্রকৃতিগতভাবে পরিশ্রমী, খাটো আকৃতির এবং এদের গাত্রবর্ণ কালো। তারা জ্ঞানচর্চায় অনুরাগী। সাগরতীরের দেশ বলে এখানে সাগরের পানি আর ভূমি পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। এখানে প্রচুর পরিমাণ মূল্যবান সামগ্রী ও রত্ন পাওয়া যায়। তাই এদেশের মানুষ সাধারণত খুবই ধনী।

ফা হিয়েনের বিবরণী থেকে সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সম্পর্কে কিছুটা তথ্য জানা যায়। তবে আজ বাংলাদেশ কিন্তু সেই চীনাদের কাছে সহযোগিতা নিয়ে দেশের উন্নয়ন করছে। সৃষ্টিকর্তার কুদরত বোঝা বড় দায়, উন্নত থেকে অনুন্নত হয়ে আবারও উন্নয়নের পথে হাঁটছে প্রিয় স্বদেশ।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম কান্ডারি চীন, যার সহস্রাব্দ পুরনো ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর সাহিত্য মানবতার উৎকর্ষের প্রজ্জ্বলিত মঙ্গলময় দৃষ্টান্তের আলোকায়ন। ইতিহাসের পটচিত্রে বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল যে পথ, তা সিল্ক রোড নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। তখনকার পশ্চিমা সিল্ক রোড, যার সূচনা হয়েছিল রাজধানী সিয়ান (তৎকালীন ছাংআন) থেকে। সেই পথ সিনজিয়াং হয়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে পৌঁছেছিল বাংলাদেশে (মংচিয়ালা)। কয়েক শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় এই বাংলাদেশ (মংচিয়ালাই) ছিল চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের একটা অনন্য সেতুবন্ধন। আরেকটি পূর্ব সিল্ক রোডও ছিল, যার উৎপত্তি হয়েছিল দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে তা সংযোগ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। এই দুটি পথ ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল, বৃদ্ধি পেয়েছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু সেই প্রমাণ আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। বিভিন্ন আকার আকৃতির প্রাপ্ত মৃত্রপাত্র, সেসব মৃত্রপাত্র তৈরির প্রযুক্তি ছাড়াও আরোপ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রাচীনকালের বাংলাদেশে কয়েকটি  প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান  চীনের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ও  বাণিজ্যিক রুট সম্পর্কে গবেষণার দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা দেয়।

প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র উপকূলীয় দেশ বিধায় সমুদ্রপথে তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ছিল চমৎকার। প্রায় ৬০০ বছর আগে চীনের মিং রাজবংশের পরাক্রমশালী সম্রাট ছিলেন ইয়ংলে। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ নাবিক অ্যাডমিরাল ঝেং হে ছিলেন সম্রাটের শান্তির দূত; তিনি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পরিভ্রমণ করেন। তিনিই সমুদ্রপথে চীনা সিল্ক রোড সৃষ্টি করেন। 

আরও পড়ুন

সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হোক

চীন—বাংলাদেশ সম্পর্ক ইতিহাসের পরম্পরায় চলমান। এই সম্পর্ক প্রাচীন ও প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন বাংলার সভ্যতা ও চৈনিক সভ্যতার মাঝে খ্রিষ্টের জন্মেরও হাজার বছর আগে থেকে পারস্পরিক আন্তঃযোগাযোগ ছিল। প্রাচীনকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর মাধ্যমে চীন এবং বাংলার মানুষের যোগাযোগ স্থাপিত হয় প্রবহমান জীবনের প্রয়োজনে। ১৯৭৫ সাল থেকে চীন বাংলাদেশর আধুনিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অন্যতম অংশীদার চীন এবং বাংলাদেশ চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক পক্ষ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী চীন থেকে দুটি সাবমেরিন তার অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত করে। চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক এখন ভারতসহ প্রতিবেশী অনেক দেশের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে চীন বন্ধু দেশ হিসেবে এগিয়ে এসেছে অর্থনীতির চাকা শক্তিশালী করতে। এতে উভয় পক্ষের স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের বক্তব্যই আছে।  বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ এর প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশে চৈনিকদের নানা সেক্টরের উন্নয়নে অংশগ্রহণ ও অবদান রয়েছে। আরও নতুন নতুন সংযোজন হচ্ছে। তবে উন্নয়নের মহাসোপানে চীনের এই নানা সেক্টরের সহযোগিতায় বাংলাদেশ যথাসময়ে ঋণের বোঝা দূর করে সফল হতে পারলে; সাধারণ জনগণ এগুলোর সুফল ভোগে লাভবান হবে এবং দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে। অন্যথায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লে অশনি সংকেত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে রয়েছেন। আশা করি, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশ যেসব চুক্তি বা সমঝোতা করবে সেখানে দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবে।  

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়