images

মতামত

যুব ক্ষমতায়ন: সময়ের অপরিহার্য দাবি

১২ মে ২০২৪, ০৫:৫১ পিএম

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ প্রতিশ্রুতিশীল গতিপথ ধরে এগোচ্ছে। সামাজিক উন্নয়ন সরাসরি আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একই সঙ্গে আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিক সমন্বয় এবং সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্যের প্রশ্নও জড়িত। সীমিত ভূমি এবং স্বল্প প্রাকৃতিক সম্পদের বিপরীতে আমাদের বিপুলসংখ্যক যুব সমাজ বাংলাদেশের অন্যতম বড় সম্পদ। দেশ গড়ার ক্ষেত্রে যুব সমাজের ভূমিকা সর্বকালেই স্বীকৃত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুব সমাজের নির্ভীক অবদানের কথা স্মরণ করে আমরা সে সত্য সহজে বুঝতে পারি। যুব সমাজ দেশ ও জাতির শক্তি, প্রকৃতপক্ষে অনন্য এক অমূল্য সম্পদ। সে অমূল্য সম্পদ যথাযথ লালন করে আমরা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। দেশের প্রতিটি খাতে আজকের যুব সমাজ ক্রমে শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে উঠবে, আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে, সেটিই সবার কাম্য। 

আজ যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর, আগামী ২০ বছর পর তারাই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের হাল ধরবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান করার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কী সোনার ছেলে-মেয়েদের জন্য আগামীতে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য-পথে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত হয়ে ওঠার রাস্তা প্রশস্ত করতে পারছি?

উপরের প্রশ্ন নিয়ে সত্যি সত্যি মাথা ঘামানোর সময় এখনই। কেবল আলোচনা বা তর্কবিতর্কের পর্যায়ে নয়; আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বায়নের গতির সঙ্গে তাল রেখে আমাদের যুব প্রজন্মের ক্ষমতায়নের রাস্তা প্রশস্ত করতে আমরা যদি অচিরেই সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অবহেলা করি, আগামীতে হয়তো আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হতে পারে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে। সেই সঙ্গে সামাজিক 
নৈরাজ্য, নৈতিক বিভ্রান্তি এবং সাংস্কৃতিক লক্ষ্যহীনতা গুরুতরভাবে ব্যাহত হতে পারে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে। সেই সঙ্গে সামাজিক নৈরাজ্য, নৈতিক বিভ্রান্তি এবং সাংস্কৃতিক লক্ষ্যহীনতার গুরুতর সংকট জাতীয় পর্যায়ে আমাদের চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

বাস্তবতা যে, বর্তমানে দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৯ শতাংশই যুব সমাজ। মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং কর্মোপযোগী দক্ষতা গড়ার সুযোগ না থাকার শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনছে না। নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার মতো আর্থিক সহায়তাও সুলভ নয়। দেশে যুববান্ধব শাসন না থাকায় পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও নাজুক। ফলে যুবকরা নিজেদেরকে বিপন্ন মনে করে, এবং নিমজ্জিত হয় হতাশায়। পরিণতিতে কেউ কেউ হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত এবং অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে চরমপন্থায়। এভাবেই যুবকদের অপার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গিয়ে প্রকারান্তরে যুবকরা দেশের বোঝা হয়ে পড়ছে। তাই মানসম্মত শিক্ষা এবং কর্মোপযোগী দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে যুবকদের ক্ষমতায়ন আজ সময়ের দাবী।

যুব ক্ষমতায়নের জন্য করণীয়:

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের যুব সমাজ। তারুণ্যের উদ্যমী শক্তি ও দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে মেধা, উদ্ভাবনী শক্তি ও কর্মোদ্যোগ দিয়ে ২০৩০ এর বৈশ্বিক এজেন্ডার আলোকে বাংলাদেশকে বদলে দিতে সক্ষম যুব সমাজ। তাই ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি, শিক্ষা, পেশা, এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে যুব সমাজকে দক্ষ, জ্ঞানবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে এসডিজির অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য যুবকদের ক্ষমতায়িত করতে হলে নিম্নোক্ত সুপারিশসমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে:

১. উন্নয়ন দর্শনে তথা সরকারি নীতিমালা ও বাজেটে মানসম্মত শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে:

ক. শিক্ষা যেন হয় কর্মমুখী, আর এ লক্ষ্যে দক্ষতা বৃদ্ধিকে রাখতে হবে সকল শিক্ষা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে।
খ. শিক্ষা পাঠ্যক্রমকে করতে হবে আধুনিক ও পরিবর্তনশীল, অর্থনীতির চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গ. শিক্ষার বহুমুখী ধারা পরিহার করে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ঘ. শিক্ষকদের জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ. গ্রাম ও শহরের মধ্যে শিক্ষার গুণগত পার্থক্য রাখা যাবে না।
চ. শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে আধুনিকায়ন করতে হবে ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।

২. যুব উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে-

ক. যুব ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
খ. যৌক্তিক সুদ নির্ধারণ করে যুব উন্নয়ন দফতরের যুব ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
গ. ব্যাংক ও সকল অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে যুব সমাজের জন্য বিশেষ স্কিমের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ঘ. বিশেষায়িত শিল্প এলাকায় যুব উদ্যোক্তাদের প্রাধিকার দিতে হবে।
ঙ. অর্থনীতির সুযোগসমূহ বাস্তবায়নের সকল কার্যক্রমে যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
চ. যুব উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা-বিনিয়োগ সহযোগী ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে।

৩. রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় যুব সমাজের উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকাশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি জেলায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে প্রাধিকার দিতে হবে।

৪. মেধার ভিক্তিতে কর্মসংস্থান ও দক্ষতার নিরীখে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে সুবিধাবঞ্চিত তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ নিয়োগের ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন উন্নয়নের মূলধারা থেকে তারা বাদ না যায়।

৫. নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রণোদনা দিতে হবে। এ জাতীয় দক্ষতা বৃদ্ধি নারী নীতিমালা ২০১১-তে যুব নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাটি সংযুক্ত করতে হবে।

৬. পাহাড় ও সমতলের আদিবাসি, দলিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের যুব সমাজের শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্ম সুযোগ সৃষ্টির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।

৭. হাওর, চরাঞ্চল ও উপকূলের যুব সমাজের উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রকল্প ও তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে।

৮. যুব সমাজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকতে হবে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা ২০১১-তে যুব সমাজের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও পদক্ষেপ থাকতে হবে এবং মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে।

৯. যুব নারী ও পুরুষদের মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে মাদকের ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদক প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

১০. যুব পার্লামেন্ট গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুব আইন-২০১৭ অনুসারে অবিলম্বে যুব কাউন্সিল গঠন করতে হবে।

১১. যুব উন্নয়ন দফতরের যুব নেতৃত্ব ফোরাম আরোও সক্রিয় ও প্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে এবং যুব উন্নয়ন দফতরের প্রশিক্ষণে এসডিজি সংশ্লিষ্ট বাধ্যতামূলক বিষয় থাকতে হবে।

১২. জাতীয় বাজেট ও বিভিন্ন পরিকল্পনায় যুব সমাজের উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। 

১৩. যুব সমাজের জনমিতিক উপযোগের সুযোগ যথার্থভাবে নেওয়ার লক্ষ্যে যুব সমাজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য রাষ্ট্রকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

১৪. পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে এবং তার নিরীখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। যুব সমাজ পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে যেসব দাবিতে উচ্চকিত, তার নিরীখে উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

১৫. যুব সমাজের উন্নয়ন ও সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত আইনসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং চাহিদার আলোকে এসব আইনের সংস্কার করতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: জাতীয় যুব নীতি ২০১৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধিত) আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এবং এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২।

১৬. যুব সমাজ যেন মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে একটি আলোকিত গণতান্ত্রিক পরিমন্ডলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় প্রণীত সংবিধানের আলোকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রয়োগ ও মৌলিক অধিকার চর্চার সুযোগ, বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্মিলিত হওয়ার অধিকার।

১৭. তথ্য-প্রযুক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবহারকারী হিসেবে যুব সমাজের তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে বাক-স্বাধীনতার অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।

১৮. যুববান্ধব শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে যুব সমাজের মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এ লক্ষ্যে-

ক) তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ের রাজনীতি, স্থানীয় শাসন ও কমিউনিটি কার্যক্রমে যুব সমাজের কার্যকর অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
খ) রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এসডিজি বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত সব কমিটিতে যুব সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব কমিটিতে যুব সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
গ) উপজেলা উন্নয়ন কমিটিতে যুব সংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১৯. রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুব সমাজের অনৈতিক অপব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রধান করতে হবে।

২০. রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশেতহারে যুব সমাজের অধিকার, উন্নয়ন ও দেশ গড়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম থাকতে হবে।এসবের নির্বাচনোত্তর নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

লেখক: সিইও, রিয়েল ইন্টেরিয়র 
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ওনার্স এসোসিয়েশন- বিডকোয়া 
অনার্স ও মাস্টার্স (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)