২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩০ পিএম
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। সাধারণ জনগণ ভেবেছিল নতুন সরকার এলে হয়তো জিনিসপত্রের দাম কমবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে সরকার গঠন করল। মন্ত্রিসভায় যোগ হলো কিছু নতুন মুখ। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমেনি। বরং নতুন সরকার আসার পর নিত্যপণ্যের দাম না কমে বেড়েই চলেছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, যদিও সরকার বলছে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে। কিন্তু তেমন কিছু এখনো চোখে পড়ছে না।
সব ধরনের জিনিসের বাড়তি দামের এই সংকটকালে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। চুলায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস থাকুক বা না থাকুক, একজন গ্রাহককে মাসে গ্যাস বিল (দুই চুলা) দিতে হয় ১ হাজার ৮০ টাকা। এই বিল এখন ৫১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলোর মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব মানা হলে দুই চুলার ক্ষেত্রে মাসে বিল আসবে ১ হাজার ৫৯২ টাকা। অন্যদিকে এক চুলার জন্য এখন মাসে বিল দিতে হয় ৯৯০ টাকা। এই বিলও ৩৯০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের সপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জমা দিতে দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে ওই কমিটি। তথ্য-উপাত্ত যাচাইয়ের পর চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যেই নিজেদের সিদ্ধান্ত কমিশনকে জানাবে তারা।
বেশ কিছুদিন ধরেই গ্যাস নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। গ্যাস নেই, রান্নায় ভোগান্তি। ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে গ্যাসের সংকট। কোথাও কোথাও কল-কারখানা বন্ধও হয়েছে। কোথাও তীব্র গ্যাস সংকটে কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ। গ্যাসের কারণে মানুষের দুর্ভোগ চরমে। রাজধানীর যেসব এলাকায় আগে বিকেলের দিকে গ্যাস আসতো— এমন অনেক এলাকার বাসিন্দারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন যে তারা এখন সন্ধ্যার পরও গ্যাস পাচ্ছেন না। মিটমিট করে চুলা জ্বলছে, তা দিয়ে রান্না হচ্ছে না। অনেকেই বিকল্প উপায়ে রান্না করছেন অথবা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে খাচ্ছেন।
এদিকে আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। একটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনাল, অন্যটি সামিট এলএনজি টার্মিনাল। গত ১ নভেম্বর এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণ শেষে টার্মিনালটি চালু করা হলেও ত্রুটির কারণে ফের বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাস পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে দাবি করে ভোক্তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনালের যান্ত্রিক ত্রুটি না হয় সারা গেল, কিন্তু সারাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের যে ঘাটতি আছে, সেটা কীভাবে দূর হবে?
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলেও বড় ধরনের সংকট হয় না। কিন্তু এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।
প্রশ্ন হলো— দুই চুলার গ্যাস ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা বিল দেওয়ার পরও যদি রান্নার জন্য ন্যূনতম গ্যাস পাওয়া না যায়, তাহলে এই বিল নেওয়াটা যৌক্তিক কি না? নাগরিকরা এখন যদি ‘নো গ্যাস নো বিল’ স্লোগান দেওয়া শুরু করেন এবং গ্যাসের বিল না দেন, তাহলে কী হবে? অন্যান্য জেলার বাড়ির ভাড়াটিয়াদের ভাড়ার সঙ্গে গ্যাস বিল যুক্ত হয় কি না জানি না। কিন্তু ঢাকা শহরের ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে গ্যাস বিল যুক্ত হয়। ফলে তারা গ্যাস পেলেন কি পেলেন না, তা নিয়ে বাড়িওয়ালাদের মাথাব্যথা নেই। বাড়িওয়ালারাও যদি গ্যাসের বিল দেওয়া বন্ধ করে দেন তাহলে কর্তৃপক্ষ হয়তো গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ফলে বাড়ির মালিকরাও গ্যাসের বিল না দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। তাহলে দেখা যাবে গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাড়ির মালিকদের পোয়াবারো। দ্রব্যমূল্য থেকে গ্যাস সবখানে বিপদে ভাড়াটিয়া তথা আমজনতা। কিন্তু এ দায় কি সরকারের নেওয়া উচিৎ না?
গ্যাসের জন্য বিল দেয়ার পরও ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় কিংবা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনতে হয়— এই বাড়তি টাকা কে দেবে? বরং বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংকটের কারণে এখন বৈদ্যুতিক চুলায় রান্না করতে গিয়ে বিদ্যুতেও অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠবে। বাধ্য হয়ে মানুষকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনে খেতে হবে। এতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও পকেট কাটা পড়বে সাধারণ মানুষের।
পাইপ লাইনে গ্যাস সংকটের কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনছেন ও রান্নার ব্যবস্থা করছেন। অনেকেই আবার সিলিন্ডার অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে করে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা ক্রমশই বড় হচ্ছে। এই খাত নিয়েও মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। পাইপ লাইনের সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত সিলিন্ডার গ্যাসের দামও বাড়ছে। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এখন শীত মৌসুম। শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যায়। ফলে বাসাবাড়ি ও কল-কারখানায় বছরের অন্য সময়ের তুলনায় গ্যাসের চাপ কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। এখন সারাদিন তো গ্যাস থাকেই না, এমনকি সন্ধ্যার পরও বাসা-বাড়িতে গ্যাসের চুলা মিটমিট করে জ্বলে। তাহলে গরমের সময় কি অবস্থা দাঁড়াবে?
অনেক সময়ই মনে হয়, নাগরিককে সেবা দেওয়ার চেয়ে ব্যবসাটাই বড়, বিশেষ করে গ্যাস খাতে। গণমাধ্যমের খবর, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ৭০৬ কোটি টাকা। এরপরও তারা মুনাফা করেছে ১৫৮ কোটি টাকা। এত মুনাফার পরও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো— জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না দিয়ে বা না দিতে পেরে বিল বাড়ানোর এই প্রস্তাব যে অযৌক্তিক এবং একইসঙ্গে অনৈতিক, সেটি কি তিতাস কর্তৃপক্ষ জানে না?
শুধু মাসিক বিল বাড়ানোর প্রস্তাব নয়, বরং তীব্র গ্যাস সংকটের ভেতরেই তিতাসের প্রিপেইড মিটারের ভাড়াও বেড়েছে। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গোপনে গ্যাসের মিটার ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকরা বিল দেন। সেখানে মিটারের ভাড়া কেন দিতে হবে, সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল। নাগরিকের সেই প্রশ্ন আমলে না নিয়ে এতদিন গ্যাসের প্রিপেইড মিটার প্রতি ১০০ টাকা ভাড়া নিতো তিতাস। এবার এক লাফে এটি দ্বিগুণ করা হয়েছে। অথচ গ্রাহকরা এটি জানতেন না। তারা বিল দিতে গিয়ে জানতে পারেন যে মিটার ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের প্রশ্ন, একটি মিটারের দাম কত? যার কারণে প্রতি মাসে সেটির ভাড়া বাবদ তাদেরকে ২০০ টাকা দিতে হবে?
বাস্তবতা হলো- গ্যাসের বিলের মধ্যেই মিটার চার্জ সমন্বয় করে নেওয়ার কথা। কিন্তু তিতাস আলাদাভাবে মিটার চার্জ নিচ্ছে। এটি নেওয়ার এখতিয়ার তিতাসের আছে কি না এবং গোপনে এই মিটার ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ করে ফেলার অধিকার তাদের আছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন- একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কীভাবে নাগরিকের অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে, তাদেরকে অবগত না করে, এমনকি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গ্যাসের প্রিপেইড মিটারের ভাড়া দ্বিগুণ করল? তার মানে তিতাস কর্তৃপক্ষ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে আমলেই নিচ্ছে না?
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যাতে আমলে নিতে না হয়, সেই আইন পাস হয়েছে ২০২২ সালেই। ওই বছরের ডিসেম্বরে জারি হয় ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন)’ অধ্যাদেশ, যেটি জাতীয় সংসদে পাস হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এই আইন অনুযায়ী, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম সরাসরি বাড়ানো কিংবা কমাতে পারবে সরকার। অর্থাৎ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে কোনো ধরনের শুনানির প্রয়োজন হবে না। তিতাস কি তাহলে এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই কমিশনকে পাত্তা না দিয়ে প্রিপেইড মিটারের ভাড়া দ্বিগুণ করল?
প্রশ্ন হলো- যদি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি ছাড়াই সরকার নিজের মতো করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে, তাহলে কমিশনের কাজ কী বা কমিশনের কোনো প্রয়োজন আছে কি? তবে তিতাসের বিরুদ্ধে গোপনে মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ এটি নতুন নয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসেও তারা এই কাণ্ড করেছিল। তখন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে কিছু না জানিয়েই গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত গ্যাসলাইনের জন্য প্রিপেইড মিটার ভাড়া ৪০ টাকা বাড়িয়ে দেয় তারা।
এমনিতেই গ্যাসের সরবরাহ নেই। সরবরাহ থাকলে চাপ থাকে না। তারপর নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে বন্ধ হবে শিল্প-কারখানা, বন্ধ হবে হোটেল। বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক। তাই শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ও অজস্র শ্রমিকের রুটি-রুজির সংস্থানের কথা ভেবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত। নতুবা গ্যাসের দাম বৃদ্ধি জনগণের কাছে বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াবে। যেটা মোটেও কাঙ্খিত নয়।
বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কথা বলে আসছিলেন, কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। তারা কম দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করেছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের পরনির্ভরশীল নীতির কারণেই পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে। আমদানির ওপর নির্ভর না করে জরুরিভিত্তিতে দেশি উৎসের অনুসন্ধান চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে যত বিলম্ব হবে, দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন ততই ঝুঁকিতে পড়বে।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট