১৪ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:১৩ পিএম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ও সুরারোপিত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুর বিকৃতি নিয়ে কিছুদিন ধরে ফেসবুক-ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম সাংঘাতিক ব্যতিব্যস্ত। প্রতিবাদ সর্বত্র! শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, বোদ্ধা-অবোদ্ধা সবাই প্রতিবাদমুখর। অত্যন্ত সংগতকারণে সবাই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সোচ্চার। কারণ, যা ঘটেছে তা ঘটার কথা নয়। যা হয়েছে তা হবার কথা নয়।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি গান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় শক্তি-সাহস ও উদ্দীপনা জোগায়। গানটি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার যে প্রবল-প্রমত্ত শক্তি যুগিয়েছিল, তা ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা হিসেবে আজও সমাদৃত। গানটির নামও ‘ভাঙার গান’। দুঃশাসন ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার গান। শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার-নিপীড়ন, নির্যাতন-অপশাসন, দুবির্চার-অনাচার থেকে উপমহাদেশকে রক্ষা করা এবং মানুষকে বাঁচানোর এক প্রবল আকুতি নিয়ে এই গানটি রচিত।
প্রেক্ষাপট ও মূলচেতনা
১৯২১ সালে ‘বাঙ্গলার কথা’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এই সমকালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সমগ্র ভারতবর্ষে চলছিল ব্রিটিশ বিরোধী ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নায়ক সাংবাদিক ও সম্পাদক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ব্রিটিশ তাঁবেদারি আদালতের নির্দেশে যখন গ্রেফতার হন, তখন তিনি তার সম্পাদিত পত্রিকাটি স্ত্রী বাসন্তী দেবীর হাতে সোপর্দ করেন। পরবর্তীতে বাসন্তী দেবী, সুকুমার রঞ্জন দাশের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের নিকট পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা চেয়ে পাঠান। এই বিষয়টি কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ ‘বাঙ্গলার কথা’র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্য পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু করে দিল। সুকুমার রঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।’
এই কবিতাটি ‘ভাঙার গান’শিরোণামে ‘বাঙ্গলার’ কথা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২০ জানুয়ারি ১৯২২ সংখ্যায়। পরবর্তীতে তিনি এই কবিতাটিতে সুরারোপ করেন এবং কাব্যগীতি পর্যায়ের এই গানটিতে প্রথম কণ্ঠ দেন ‘গিরীন চক্রবর্তী’।
গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠে এই গানটি জানুয়ারি ১৯৫০ সালে এইচএমভি (এন.৩১১৫২) রেকর্ড করে। ‘সামরিক মার্চ’ এর সুরে এবং ‘দাদরা’ তালে গানটি সুসংরক্ষিত। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ চলচ্চিত্রে ১৯৪৯ সালের ২৭ নভেম্বর গানটি প্রচার করা হয়। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান গানটি ব্যবহার করেন। সেখানে পায়ে নূপুরের বদলে শিকল বাঁধা অবস্থায় পা-নাচানোর দৃশ্যটি গভীর অর্থবোধক।
গানের ভাষা ও আবেদন
কাজী নজরুল রচিত অন্যতম সার্থক গানটি এরূপ- কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,//রক্ত-জমাট/ শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।/ ওরে ও তরুণ ঈশান!/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!/ ধ্বংস নিশান/ উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।/ গাজনের বাজনা বাজা!/ কে মালিক? কে সে রাজা?/কে দেয় সাজা/মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?/ হা হা হা পায় যে হাসি,/ ভগবান পরবে ফাঁসি!/ সর্বনাশী/ শেখায় এ হীন তথ্য কে রে!/ ওরে ও পাগলা ভোলা!/ দে রে দে প্রলয় দোলা/ গারদগুলা/জোরসে ধরে হেচ্কা টানে!/মার হাঁক হায়দারী হাঁক,/ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক/ ডাক ওরে ডাক,/ মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!/ নাচে ওই কালবোশাখী,/ কাটাবী কাল বসে কি?/ দে রে দেখি/ ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!/ লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!/ যত সব বন্দী শালায়/ আগুন-জ্বালা,/-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
গানটির ভাষা, ছন্দালংকার যে কারোরই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যে যুগে প্রযুক্তির এতো প্রসার ছিল না, সে-যুগেও এই গানটি মানুষের ভালোবাসা ও আবেগে স্নাত হয়ে মুখে মুখে ভাইরাল হয়ে যায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এতোটাই আলোড়ন তোলে যে, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী গানটিকে নিষিদ্ধ করে। গানটি প্রচার-প্রসার এমনকি গাইলেই জেল-জুলুমের কবলে পড়তে হবে। এই ধরনের লেখালেখির জন্য নজরুলকে কারাবরণও করতে হলো। অথচ কোনো কিছু আমলে না নিয়েই গানটির ওপর ছুরি চালাচ্ছে আজও কেউ কেউ। সে-যুগে ব্রিটিশ খড়গ আর এ যুগে তার এই সমস্ত সর্বকালোত্তীর্ণ গানের সাথে চলছে প্রত্যাখানযোগ্য বেয়াদবি।
সুর বিকৃতি ও অপরাধের মাত্রাজ্ঞান
নজরুল গানে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই তারাই তার গানের তাল-লয়, মাত্রা-ছন্দ উপেক্ষা করে মাত্রাতিরিক্ত অপরাধে অপরাধী হচ্ছেন। নজরুল-রবীন্দ্রনাথ বা লালন ফকির অথবা যেকোনো গীতিকবির গানের কথার সঙ্গে প্রথম যে সুরটি আরোপ করা হচ্ছে সেটি, সেই গীতি কবির সম্মতিতে; এরপর সেই গানটি অন্যসুরে গাইতে গেলে তো সেই কবির সম্মতি প্রয়োজন। কবি বেঁচে থাকলে তার অনুমতি সাপেক্ষে সেটি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রয়াত কবির ক্ষেত্রে কী হবে? এবং কবি যদি হন নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ! তখন কী হবে? যারা শুধু বাংলাদেশ নয়। গান লিখে ও সুর করে পৃথিবীর সকল কবিকে ছাড়িয়ে গেছেন!
নজরুল গানে অনেকেই সুরারোপ করেছেন, তবে তা তাঁর সরাসরি সম্মতিক্রমে। আর তিনি যে সুর করেছেন তা সবচেয়ে সুন্দর ও উপযুক্ত। নজরুল সংগীতের আদি সুরের কোনোই পরিবর্তন প্রয়োজন নাই, এই কারণে যে, তাঁর সব সুরই সর্বাঙ্গীন সুন্দর, উপযুক্ত, যুগোপযোগী এবং আধুনিক। একজন একটি সুন্দর চাদর সঠিকভাবে শরীরে জড়িয়ে আছেন, সেটি ধরে টানাটানি করা যে, শুধু বেয়াদবিই নয়, বরং দৃষ্টিকটু এবং শুনতেও সাংঘাতিক শ্রুতিকটুও।
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুর ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলার, অর্ধচেতনকে সচেতন করা ও পরাধীন জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ-উদ্দীপ্ত করার প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। এই গানের অন্য কোনো সুর হতেই পারে না। এই গানের এই একটি সুরই যথার্থ, উপযুক্ত ও সঠিক। দুই এবং দুই-এর যোগফল চার। এখন কেউ আবদার করল, আমি তিন অথবা পাঁচ লিখব। তাহলে এটি পাগলামি! নজরুলের গানের সুরে এ ধরনের পাগলামির সুযোগ কোথায়? কারণ নজরুল তো শুধু গীতিকবি নন; তিনি তো সংগীত বিশারদ ও সংগীত গবেষকও বটে। যারা তার শিষ্য-প্রশিষ্য হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না, কালান্তরে তাদের হাতেই যদি তাঁর সংগীত, সুরের দ্বারস্থ হয়; তাহলে যা হবার তাই-ই হয়। তাই-ই হয়েছে! এতে আর বিস্মিত হওয়ার কী আছে?
তবে নজরুল বাংলা সাহিত্যের ও বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। কেউ চাইলেই তাকে পরিবর্তন করতে পারেন না। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- যারা নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুর বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা যদি কবি পরিবারের অনুমতি নিয়ে থাকেন তবে কী অপরাধ হবে? প্রথমত কবি পরিবার নিশ্চয়ই সুর পরিবর্তন করে গাওয়ার অনুমতি দেননি। হয়তো চলচ্চিত্রে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেন- যা হবার নয়; যদি দিয়ে থাকেন, তা তারা পারেন না। কারণ কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। সরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সস্টিটিউট রয়েছে। নজরুলের বিষয়ে শুধু তাঁর পরিবার একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা লালন যে কবিই হন, তাদের সাহিত্যের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তের আগে সরকারি অনুমোদনের বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। ফিউশান, আধুনিকায়ন বা প্যারোডি ইত্যাদির নামে জাতীয় চেতনাবিরোধী কোনো পদক্ষেপ যাতে কেউ নিতে না পারেন তজ্জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার, যেখান থেকে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও লালন বা খ্যাতিমান যে কারোর গান-কবিতা ব্যবহারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে। রয়্যালিটির অর্থ স্ব স্ব কবির পরিবার পাবেন। তবে তাঁরা যদি বিশেষজ্ঞ না হন, তাহলে শুধু কবির আত্মীয় হওয়ার কারণে মতামত প্রদান করতে পারবেন না। এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে একদিন হয়তো জাতীয় সংগীত, রণসংগীতেরও সুর বিকৃতি দেখার মতো দুর্ভাগ্য জন্মাবে এ জাতির জীবনে।
লেখক: নজরুল গবেষক এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার