ঢাকা মেইল ডেস্ক
০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম
আজ ১ অক্টোবর রোববার বিশ্ব প্রবীণ দিবস। প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রতিবছর সমগ্রবিশ্বে এ দিবস পালিত হয়। বিশ্বব্যপী বিরাজ করছে বিবিধ মানবিক ইস্যূভিত্তিক সামাজিক সংকট। বিবিধ সামাজিক সমস্যার প্রাসঙ্গিকতা সর্বমহলে তুলে ধরার জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। বার্ধক্য বা প্রবীণ বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম সামাজিক সমস্যা। আধুনিক রূপান্তরিত সমাজব্যবস্থায় প্রবীণ সংকট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রবীণ ব্যক্তি কারা? প্রবীণ ব্যক্তি হলো আমাদের অতি আপনজন এবং সমাজের শ্রদ্ধেয় গুরুজন। এ সমাজ-সভ্যতার রূপকার। জীবনব্যপী নিজ শ্রম ও মেধা শক্তির মাধ্যমে সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নে নিরন্তর ভূমিকা পালন করেছে। জীবন উৎসর্গ করেছে পরিবার, সমাজ ও দেশের তরে। কিন্তু সমাজে দেখা যায় বিরূপ চিত্র। পিতা-মাতা হিসেবে একজন প্রবীণ প্রথমে নিগৃহীত হচ্ছে আপনার সন্তানের কাছে। সামাজিকভাবে তারা আজ অসম্মানের পাত্র। বার্ধক্যে উপনীত একজন প্রবীণ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সমাজের প্রবীণেরা চিকিৎসা, আবাসন, বিনোদন, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ বিবিধ অধিকার হতে বঞ্চিত।
মানব জীবনচক্রের বিবিধ ধাপ বা স্তর আছে। জীবনচক্রের অন্যতম ধাপসমূহ হচ্ছে: নবজাতক, শিশুকাল, শৈশবকাল, কৈশোরকাল, যৌবনকাল, পূর্ণবয়স্ক ও বার্ধক্য। জীবনের ধাপে ধাপে মানুষের চাহিদা আছে। বার্ধক্য জীবনচক্রের শেষ ধাপ এবং মানব জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। জীবনচক্রের স্তর ভেদে মানুষের চাহিদা, কর্মক্ষমতা, উপার্জন ক্ষমতা ও মানসিক শক্তির মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত। একজন ষাট বছর এবং তদূর্ধ্ব ব্যক্তি প্রবীণ বা বার্ধক্যে উপনিত হিসেবে বিবেচিত। এ বয়সে মানুষ ক্রমান্বয়ে শারিরীক শক্তি, মানসিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
দেশের প্রবীণ ব্যক্তিগণ মূলত তিন ধরণের সমস্যায় ভোগে যথা: স্বাস্থ্যগত সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা ও মনস্তাত্বিক সমস্যা। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে জীবনচক্রের ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে যা হচ্ছে: ক্রমাগত স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া, কাজের অক্ষমতা, পারিবারিক যত্নের অভাব, সামজিক অংশগ্রহণ সীমিত, শ্রম শক্তিতে বৈষম্য ও ঋণ না পাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ঝুঁকিহীন, সমস্যমুক্ত ও শংকাহীন জীবন প্রবীণ ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার।
আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য সেবায় অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বৈশ্বিক জনমিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটছে। জাসিংঘের জনসংখ্যা প্রতিবেদন-২০১৫ অনুযায়ী, পৃথিবীতে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ৯১ কোটি ৮৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। এ ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা প্রতিবছর ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমান জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি হবে এবং ২১০০ সালের মধ্যে তিনগুণের বেশি হবে। সংখ্যায় যার পরিমাণ দাঁড়াবে ২০৫০ সালের মধ্যে ২.১ বিলিয়ন এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৩.২ বিলিয়ন (সূত্র: জাতিসংঘ-২০১৫)।

সরকারের বিবিধ কল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে সামাজিক সূচকে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। দেশের বর্তমান গড় আয়ু ৭২.৪ শতাংশ এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবীণের সংখ্যা। জনশুমাররি ও গৃহগণনা-২০২২ এর তথ্য মতে দেশে বর্তমান প্রবীণের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন। যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। ইউএনএফপি এর প্রাক্কলন মতে ২০৫০ সালে দেশে ৬০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সীদের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। তাই ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে প্রয়োজনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা রোধ, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা, সমঅধিকার ও সকল জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গিকার নিয়ে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের যাত্রা। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’ গ্রহণ করে। এ ঘোষণাপত্র বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য মাইল ফলক এবং এক আন্তর্জাতিক দলিল। মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৫নং ধারায় উল্লেখ ‘কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা অবমাননাকর আচরণ করা কিংবা কাউকে নির্যাতন করা বা শাস্তিভোগ ভোগ করতে বাধ্য করা চলবে না’। তাছাড়া ২২ নং ধারায় মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার এবং অন্যান্য ধারায় প্রবীণসহ সকল মানুষের অধিকারের বিষয় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। প্রবীণ ও বার্ধক্য সমস্যা মোকাবেলা এবং বিশ্বব্যাপী প্রবীণ বিষয়ক সচেতনতা জোরদার করার জন্য ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ভিয়েনাতে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রবীণ ব্যক্তির স্বাধীনতা, যত্ন, মর্যাদা ও আত্ম-সন্তুষ্টির জন্য প্রবীণ বিষয়ক জাতিসংঘ নীতিমালা প্রণিত হয়।
দেশে সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে প্রবীণ নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যপক হারে। দেশের প্রবীণেরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অবজ্ঞার শিকার। প্রবীণ নির্যাতনের বিরূপ চিত্র প্রায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার। এ হিসেবে বিশ্বের ১৬ কোটি প্রবীণ নির্যাতনের শিকার। দেশে বার্ধক্যে উপনীত একজন প্রবীণ যে কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের ধরণসমূহ: শারিরীক, মানসিক, আর্থিক, আবেগজনিত, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অবহেলা, বঞ্চনা, অসম্মান, দুর্ব্যবহার, রূঢ় আচরণ,গালমন্দ ইত্যাদি।
নগরের প্রবীণেরা বিষন্নতা ও একাকীত্বে জীবন যাপন করছে। দেশে গ্রামে বসবাসকারী প্রবীণেরা আজ সুরক্ষিত নয়। উপার্জন ক্ষমতা ও রতিশক্তি হ্রাস পাওয়ায় প্রবীণদের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা দায়। আমাদের বিধাব প্রবীণেরা তুলনামূলক অধিক সুরক্ষিত। বিধবা প্রবীণেরা সন্তানের নিকট হতে অধিক হারে সেবাযত্ন ও মর্যাদা পাচ্ছে। অপরদিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ প্রবীণের অবস্থা করুন। আমার অনেক নিকট আত্মীয় পুরুষ প্রবীণ যারা স্ত্রী হারিয়েছে, গ্রামে গেলেই তাদের দুর্দশার কথা শুনি এবং অসহায়ত্ব সরাসরি দেখতে পাই। তারা বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, এসব প্রবীণের দুর্গতিতে গোটা সমাজ অনুতপ্ত।
বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। এ সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার ও সমাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার প্রবীণকল্যাণে বিবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রবীণ ব্যক্তির সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ‘বয়স্কভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করে। চলতি বর্ষে ৫৮.১ লাখ প্রবীণ ব্যক্তির মাঝে বয়স্কভাতা বিতরণ করা হবে। ২০২৩-২০২৪ বর্ষে ২৫.৭৫ লাখ মহিলার মাঝে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা’ বিতরণ করা হবে যার মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার প্রবীণ নারী।
সরকার প্রবীণকল্যাণে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩’ ও ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩’ প্রবর্তন করেছে। ২০১৪ সালে দেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অবহেলিত ও অরক্ষিত প্রবীণব্যক্তির সুরক্ষার জন্য সরকারিভাবে পরিচালিত শিশু পরিবারসমূহে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাছাড়া নিগৃহীত প্রবীণদের সার্বিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে ৮ বিভাগে ৮টি শান্তি নিবাস স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। দেশে এমন অনেক ধনাঢ্য প্রবীণ আছে, যাদের সেবা, যত্ন ও পরিচর্যার কেউ নেই। তাদের কল্যাণে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ‘কেয়ার গিভার’ নামে সমাজকর্মী তৈরি করার বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
প্রবীণ হচ্ছে বর্তমান আধুনিক সভ্যতার স্থপতি। এ সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান অনন্য। প্রবীণেরা হচ্ছে জ্ঞানের মশাল, ধীর, স্থির ও শান্ত-সৌম্যের রূপকার। প্রবীণব্যক্তি হলেন সামাজিক উন্নয়নের কারিগর ও বহুবিধ অর্জনের নায়ক। প্রবীণেরা তরুণদের শিক্ষাগুরু, পথের দিশা ও অন্ধকারের আলোকবর্তিকা। প্রজ্ঞাবান প্রবীণের সান্নিধ্য, সহচার্য ও হিতোপদেশ প্রজন্মকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রবীণদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে নিয়ে সাজাতে হবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। নবীনরাই প্রবীণদের শ্রমে গড়া বর্তমান সমাজের চরম সুবিধাভোগী। তাই প্রবীণকল্যাণে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ও সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নতুন প্রজন্মকে সঙ্গবদ্ধ হতে হবে। প্রবীণবান্ধব সমাজ হোক সকলের অঙ্গীকার।
লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম