images

মতামত

তানজিম সাকিবের ফেসবুক পোস্টের পোস্টমর্টেম

ঢাকা মেইল ডেস্ক

২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:২৪ পিএম

তানজিম সাকিব ইস্যু নিয়ে তো কপচাকপচি কম হয়নাই, এবার আমি দুইটা কথা কইবার চাই। আমি আমার বক্তব্যকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে চাই।

প্রথমত, তানজিম সাকিব যে পোস্টগুলো দিয়েছেন এগুলো একান্তই তার ব্যক্তিগত মতামত, এটা তার জীবনবোধ, তার চিন্তা, তার চেতনা, তিনি লিখেছেনও নিজের টাইমলাইনে। তাই এটাকে পরিবর্তন করা অথবা না করাও তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। একটা গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেকের মত প্রকাশের অধিকার বা স্বাধীনতা থাকা উচিত।

দ্বিতীয়ত, আপনি যখন একটা স্থানে পৌঁছে যাবেন তখন আপনি চাইলেই কিন্তু যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না। আপনাকে কিছু নিয়ম-কানুন রীতিনীতি সমাজ পরিবেশ পরিস্থিতি স্থান কাল পাত্র বুঝে কাজ করতে হবে, কথা বলতে হবে। যেই কথাটা আমি সাকিব আল হাসানকে নিয়ে বহুবার বলে আসছি। কিন্তু সাকিবকে নিয়ে বললে আবার মানুষ ঠিকই ক্ষেপে যাবে। যাই হোক এই বিষয়টায় পরে আসি।

তিন নম্বরে বলতে চাই- পর্দা নিয়ে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রত্যেক নরনারীর জন্য পর্দা ফরজ। শুধু নারীদের কিন্তু নয়, পুরুষদেরও পর্দা করতে হবে। আপনি আমি করছি না সেটা আলাদা বিষয়, তাই বলে ওপেনলি পর্দাকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নাই। আপনি করবেন না কিন্তু অস্বীকার করবেন বা সেটাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করবেন তা হবে না, এতে অনেকেই কষ্ট পাবে।

তবে একজন ভুল কিছু করলে সেটার সমালোচনা করা অবশ্যই ঠিক। যেকোনো কাজেরই সমালোচনা থাকা উচিত। কিন্তু তাই বলে অল্প বয়সী একটা ছেলে যাতে বুলিংয়ের শিকার না হয় সেটাও আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। এমন অতিরঞ্জিত কিছু যাতে আমরা না করে ফেলি তাতে ছেলেটা মানসিকভাবে আঘাত পায়, ভেঙে পড়ে কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

চার নম্বর কথা হচ্ছে অনেকের পোস্টেই দেখলাম তানজিম সাকিব একজন প্রাক্টিসিং মুসলিম। খুব ভালো কথা, কিন্তু তার প্রাক্টিসিং মুসলিম হওয়ার যথাযথ প্রয়োগ আমি দেখলাম না। তিনি যেসব পোস্ট করেছে তাতে কোনো কোরআনের আয়াত বা হাদিসের রেফারেন্স কিন্তু দেখলাম না। তিনি যা বলেছেন তা কোনো হাদিস দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন কি না আমি জানি না। তবে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে, বেশ কয়েকজন আলেমদের সাথে কথা বলে জানলাম যে, নারীদের কোনো কাজে নিষেধ নেই। তবে তা অবশ্যই পর্দার সাথে করতে হবে (যদি তিনি মানেন আরকি)। যারা পর্দা করতে চান তারা পর্দা করেই যা যা করার সম্ভব তা করবেন। যারা পর্দা করেন তারা তো এসব প্রশ্নে যাবেনই না।

এখন কথা হচ্ছে, ইসলামে পর্দা করা ফরজ কিন্তু অন্য ধর্মে তো তা নাও হতে পারে, আমাদের দেশে একটা জনগোষ্ঠী আছেন যারা প্রাক্টিসিং মুসলিম না। এতবড় একটা জনগোষ্ঠীর কাছে কথাগুলো খারাপ লাগার মতোই।

আমাদের প্রিয়নবী সা. ইসলাম প্রচার করেছেন কতটা মধুরভাবে, নরম হয়ে। কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, তানজীম সাকিবের ইসলাম প্রচারের ধরনটার মধ্যে দাম্ভিকতা, অজ্ঞতা এবং নারীদের প্রতি অসম্মান প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়। কথাগুলো আরও সুন্দর করে বলা যেতো। তিনি যেহেতু প্রাক্টিসিং মুসলিম, তাহলে তিনি এখানে হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি।

তিনি যেহেতু কঠোরভাবে ইসলাম পালন করতে চান, সেটা আবারো জাস্টিফাই করেছেন, তাহলে তিনি নিজে যদি ইসলামের পরিপন্থী নয় এমন কাজ করেন তাহলে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। যেমনটা তার ক্রিকেট খেলা নিয়ে উঠেছে, আবার তার স্ত্রীর যদি বাচ্চা হয় তাহলে তিনি পুরুষ ডাক্তারের কাছে যাবেন কি না এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে! খুব স্বাভাবিক। আপনি যখন নিজেই মানুষকে জ্ঞান দেবেন, মানুষও আপনাকে দেবে। তাই প্যান্ট বানানোর আগে চেইন রেখে নেওয়া উচিত।

পাঁচ নম্বর কথা, আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় একটা পরিবারে শুধু একজনের উপার্জন দিয়ে চলা সবার পক্ষে সম্ভব না। অনেক ক্ষেত্রেই দুইজনকে উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে সন্তানকে সময় দেওয়া কঠিন হতে পারে সেটাও ঠিক। কিন্তু বাস্তবতা আর পরিস্থিতির বিচারে দুইজন কাজ করতে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হয়।

ভার্সিটির ছাত্রীদের নিয়ে যেটা লিখেছেন সেটা নিয়েও আমার দ্বিমত আছে। ভার্সিটিতে ফ্রি মিক্সিং আড্ডা দিলেই যে সে খারাপ হবেন তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে তিনি বলতে পারেন না। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেকোনো সময় হেদায়েত দিতে পারেন। আমাদের দেশে অনেক মেয়েরাই বিয়ের পরে কিংবা বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পরে পরিবর্তন হয়ে যান, আলহামদুলিল্লাহ। মানুষের ভালো হওয়া মন্দ হওয়া আল্লাহ তায়ালার হাতে। এমনও তো হতে পারে আগামীকালই মি. তানজিম সাকিবের ওপর থেকে হেদায়েত উঠে গেল, উনি কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন যে, তিনি চিরকাল ইসলামের পথে থাকতে পারবেন? তিনি কি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, তিনি ইমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবেন?

যেখানে এক মুহূর্তের নিশ্চয়তা মানুষের নাই সেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে মন্তব্য করা ঠিক না। এমনটা হতে পারে যে, ফ্রি মিক্সিং আড্ডা যারা করেন এমন মেয়ে তিনি পছন্দ করেন না বা তিনি বিয়ে করবেন না। কিন্তু তারা লজ্জাশীলা মা হতে পারবেন না এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার ক্ষমতা তাকে কেউ দেননি।

ছয় নম্বর কথা, আচ্ছা ভাই এক মুখে দুই কথা কিন্তু বেমানান। দেশের সেক্যুলার বা মুক্তমনা দাবি করা অনেকেই দেখলাম তানজিম সাকিবের গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিচ্ছেন। তারাই আবার অনেকে বলেন, তসলিমা নাসরিনকে কেন দেশছাড়া করলো! তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। মাই বডি মাই রুলস যারা বলেন, তারাও সাকিবের পোস্ট নিয়ে যা-তা বলছেন। সেটা কেন করবেন? আপনাদের মাই বডি মাই রুলস হলে, তার কেন মাই ফেসবুক মাই থটস হবে না?

আরেকটা কথা, এই সাকিবের বেলায় এক আচরণ, আরেক সাকিবের বেলায় আরেক আচরণ করা তো ঠিক না। সাকিব আল হাসান ব্যবসায় নাম বদল করে টাকা মেরে দিলে তখন বলবেন, ব্যক্তি সাকিব আর খেলোয়াড় সাকিব আলাদা, কিন্তু এই সাকিবের তাহলে ব্যক্তিগত কার্যক্রম কেন উঠে আসবে?

সাত নম্বর কথা, অনেকেই বলছেন, সাকিব আল হাসান বাদে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাকি সবাই নাকি খেলা বাদ দিয়ে ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত, আমি বলব, আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের সবার যেটা নীতিগত দায়িত্ব সেটা যদি তারা করে সেটার জন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এটাতে যদি কেউ বিরোধিতা করে করুক, নবী সা. এবং সাহাবিরা ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অনেক বাধার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যেই হয়ত উত্তম কিছু নিহিত আছে।

তানজিম সাকিবের ইসলাম প্রচারের ধরনটার মধ্যে দাম্ভিকতা, অজ্ঞতা এবং নারীদের প্রতি অসম্মান প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়। কথাগুলো আরও সুন্দর করে বলা যেতো। তিনি যেহেতু প্রাক্টিসিং মুসলিম, তাহলে তিনি এখানে হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। 

আট নম্বর, অনেকেই আবার বলছেন, ভারতের সাথে ম্যাচ জেতার পরেই এই পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। এটা আমার কাছে কাকতালীয় মনে হয়েছে, কারণ এই ম্যাচের পারফরম্যান্স তাকে আলোচনায় এনেছে, এজন্য হয়তো তার ফেসবুক নিয়ে সবাই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে (হয়তো ভালোর জন্যই করেছে)।

এই কারণে এইসব পোস্ট সামনে এসেছে। এটা পাকিস্তানের সাথে জিতলেও আরেক গ্রুপ কথা তুলতো।

তবে একজন ভুল কিছু করলে সেটার সমালোচনা করা অবশ্যই ঠিক। যেকোনো কাজেরই সমালোচনা থাকা উচিত। কিন্তু তাই বলে অল্প বয়সী একটা ছেলে যাতে বুলিংয়ের শিকার না হয় সেটাও আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। এমন অতিরঞ্জিত কিছু যাতে আমরা না করে ফেলি তাতে ছেলেটা মানসিকভাবে আঘাত পায়, ভেঙে পড়ে কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ে।

নবম এবং শেষ কথা, তানজিম সাকিব নাকি জাতীয় সংগীত গায় না। এমনও হতে পারে যে, তিনি মনে মনে গেয়েছেন, মনে মনে গাওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। কিন্তু তিনি যদি না গেয়ে থাকেন সেটাও সঠিক নয়, তার মনের মধ্যে তো আমরা ঢুকতে পারব না, তাই বলতেও পারব না। এটা নিয়ে না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না।

দিনশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশি, এখানে নানা ধর্মের নানা মত ও জাতের মানুষের বসবাস। যদি কোনো একটা প্রজাতির একজনও মানুষ থাকে, তারও একটা সম্মান রয়েছে। প্রত্যেকের আলাদা ধর্মীয় বিশ্বাস থাকবে, কারও কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস নাও থাকতে পারে। কিন্তু কেউ কারও বিশ্বাসকে আঘাত না করাই উচিত। ভুল কিছু করলে কথা বলাও উচিত তবে সেটা আক্রমণ নয়, ইতিবাচক সমালোচনা হোক। আর দেশীয়ভাবে জাতীয়ভাবে আমাদের প্রত্যেকের স্ব স্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। ধন্যবাদ, সবাই ভালো থাকবেন।

লেখক: লেখক, কলামিস্ট