images

মতামত

ছিটমহল: জীবন বদলের গল্প

ঢাকা মেইল ডেস্ক

৩১ জুলাই ২০২৩, ০৯:২৯ পিএম

ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ভূখণ্ড। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল ছিল মোট ১২টা, তার মধ্যে প্রধান দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই ছিল চন্দ্রখানা নামে বাংলাদেশের একটি ছিটমহল।

দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ছিল ১৬২টি ছিটমহল। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতে। ২০১৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের ছিটমহলগুলোর লোকসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার। আর বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর লোকসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর। ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এরমধ্যে ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারিতে ছিল ৪টি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে— ৪৭টি কুচবিহার ও ৪টি জলপাইগুড়ি জেলায়।

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্যদিয়ে রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ড থেকে যায় অন্য দেশের অংশ হিসেবে। উদ্ভব ঘটে এক মানবিক সমস্যার। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তিতে বলা আছে— ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন যেখানে থাকতে চাইবে সেখানেই থাকতে পারবে। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর ছিটমহলবাসী ও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সমস্যা সমাধান কার্যকর হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে। বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২টি ছিটমহল বিলুপ্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে স্থানীয়রা মোমবাতি প্রজ্জ্বালন করে উল্লাস প্রকাশ করেন।

ছিটমহল বিলুপ্তির আগের অভিজ্ঞতার কথা বললে বর্তমানের বদলে যাওয়া চিত্রকে আর মনে পড়ে না। লালমনিরহাটে ছিল ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। এই ছিটমহলে ঢুকতেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) নিরাপত্তা চৌকি। এরপর তিনবিঘা করিডর। আবার বিজিবির চৌকি। মাঝখানের তিনবিঘা করিডর ভেদ করে চলে গেছে ভারতীয় সড়ক। সড়ক ও করিডরের নিয়ন্ত্রণ করে বিএসএফ। এই সড়কেই বিএসএফের গেট। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সব বাসিন্দার একটাই চিন্তা নিয়ে দিন গুজরান করতে হতো— যে করেই হোক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে যে ‘গেট ফেইল’। গেট ফেইলের বৃত্তে বন্দি ছিল এখানকার ১৫ হাজার মানুষের জীবন। বাংলাদেশ থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যেতে ভারতের তিনবিঘা করিডর পেরোতে হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তিনবিঘা করিডরের গেট খুলে দিত সকাল সাড়ে ৬টায়। গেট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। মাঝখানের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সবার বাইরের কাজ সারতে হতো।

সেই জীবনের কথা মনে করে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার ছেলে বাবুল মিয়া (৩৪) বলেন, জীবন মনে হতো জেলখানার মতো। সকাল সাড়ে ৬টার আগে গেট খুলবে না, আবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে বন্ধ, এর মধ্যে কত বিপদ-আপদ হয়েছে। সব চোখ বুজে সহ্য করতে হতো। যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আমার জীবনে এমন মুক্ত বাতাস দেখতে পারব তা কোনোদিন ভাবিনি।

ছিটমহল বিলুপ্তির পরে কুড়িগ্রামের বিশাল ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় ঢুকতেই ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নীল কমল নদের ওপর একটি ৩৬ মিটার সেতু চোখের কোণে ভেসে উঠল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৭ সালে এই সেতু নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এতদিন ছিটমহলবাসীর যাতায়াতের দুঃখ ছিল এই নীল কমল নদ। এই সেতুর মাধ্যমে সেই দুঃখ দূর হয়েছে। সেতু পার হলেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে নির্মিত দাশিয়ারছড়া সংবলিত মানচিত্র ও সাম্প্রতিক উন্নয়নের তথ্যফলক। সেখান থেকে ডান দিকে কালীরহাট সড়ক হয়ে সমন্বয়পাড়া, বোর্ডঘর, রাসমেলা, টংকার মোড়, বানিয়াটারী ও ছোট কামাত গ্রাম ঘুরতেই চোখে পড়ল অনেক ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। ছিটমহল বিনিময়ের আগে এসব ঘরের বেড়া ও ছাউনি ছিল টিনের। এখন কিছুদূর পরপর আধাপাকা ঘর।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দাশিয়ারছড়াতে প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। স্থানীয় উদ্যোগে নির্মিত তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ ইতিমধ্যে পাঠদানের অনুমতি পেয়েছে। জাতীয়করণ হয়েছে একটি মাদ্রাসা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার। বহুকালের রাষ্ট্রীয় সুবিধাবঞ্চিত ছিটমহলগুলোয় বইছে শান্তির হাওয়া। সবুজ ফসল আর গাছ-গাছালিতে ভরা ছিটমহলে উঁকি দেয় চকচকে বাড়ি-ঘর। যেগুলো একসময় ছিল ঝুপড়ি ঘর, ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হওয়ার অল্পদিন পরই সেখানে শুরু হয় উন্নয়নের কাজ।

দাশিয়ারছড়ার করম আলী (৬০), শাজাহান মিয়া (৫৬) বলেন, সরকার বিনা খরচে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ-সংযোগ স্থাপন করেছে। যেসব সড়কে দীর্ঘ ৬৮ বছরে ( ১৯৪৭-২০১৫) বছরে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামান্য মাটিও পড়েনি, সেসব সড়ক এখন পিচঢালা। শুধু পঞ্চগড়েই প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়ক পাকা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ছিটমহলগুলোয়ও প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পাকা হয়েছে। ছিটমহলগুলোর সড়ক প্রায় সবই পাকা হচ্ছে। অনেক ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। ছিটমহলে অনেক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের গারাতিতে ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদ্রাসা এবং কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় একটি মাদ্রাসাকে সরকারি ঘোষণা করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে দুটি ছিটমহলে দুটি স্কুলকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোয় এখন আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি স্নাতক পর্যায়ের কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আছে মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান এবং শ্মশান। সবই সরকারের অবদান।

কুড়িগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, মূলত ছিটমহল তুলে দেওয়ার আগে সেখানকার যে পরিস্থিতি ছিল সেটা মিডিয়ায় বারবার এসেছে। বলা যায়, ভালো ছিল না। তুলে দেওয়ার পরে কি হবে সেটা নিয়ে আমরা বুঝতে পারছিলাম না? কিন্তু এখন সেখানে উন্নয়নের গতিপ্রবাহ দেখে বিস্মিত হতে হয়। স্কুল, কলেজ, মন্দির, মসজিদ সব হয়েছে। পাকাবাড়ি, বিদ্যুৎ আছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবে যে উন্নয়ন একটা এলাকায় হয় তারচেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। এক কথায় এটাকে জীবন বদলের গল্প বলা যায়।

সাংবাদিক এমএস সাগর জানান, ঐতিহাসিক এ সংকটের সমাধান ছিটমহলবাসীর জীবনে কি পরিবর্তন আনবে, ছিটমহল বিনিময়ের আগে সেখানকার লোকজনের এ বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। পরিচয়হীন এসব মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকট ছিল। তারা বঞ্চিত ছিলেন মৌলিক অধিকার থেকে। ছিটমহল বিনিময়ের পর যে সুফল তারা পেয়েছেন, তাতে তাদের জীবনের অতীতের অস্বস্তিগুলোর অবসান হয়েছে।

সাংবাদিক লাইলি বেগম জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকে চলে আসা এই জটিল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে বর্তমান সরকার এই অঞ্চলের মানুষকে এমন এক জীবন দান করেছে যা একদম চিন্তার বাইরে ছিল। এখন সেখানে যে শান্তির প্রবাহ চলছে তা দেখলেও ভালো লাগে। বর্তমান সরকারের এই মহান উদ্যোগে দেশবাসী দেখছে এক জীবন বদলের গল্প।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক