হাবীব ইমন
২৫ মার্চ ২০২২, ১০:১১ পিএম
এক.
এই তো সেদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। সাথে ছিল আমার বোন। ওরে বললাম, চল্, তোকে একটা জায়গা দেখাই। সে বললো, কোথায়।
আমি কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ালাম। এইপ্রথম বোনের এখানে আসা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। বেশ আবেগতাড়িত হলো বোন। এখানে বহুবার এসেছি আমি, প্রতিবারই রোমাঞ্চিত হই।
জীর্ণ দেয়াল। ভেতরে কতগুলো কাঠের চেয়ার-টেবিল। খুব বেশি আড়ম্বর নেই। কিন্তু এই অনাড়ম্বর আয়োজন টিকে আছে দশকের পর দশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা যে ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মধুর ক্যান্টিন অন্যতম। বিশেষত দেশের ছাত্র রাজনীতির কথা বলতে গেলে সবার আগে উচ্চারিত হবে এই ক্যান্টিনের নাম। এক সময় তো দেশের রাজনীতি পরিচালিত হতো ছাত্র রাজনীতির সোচ্চার কণ্ঠের প্রতিবাদে, বিক্ষোভে। অর্থাৎ সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত নানা আন্দোলন সংগ্রামে রয়েছে ছাত্র রাজনীতির অবদান। এই মধুর ক্যান্টিন থেকেই ছাত্ররা আওয়াজ তুলেছেন। প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে শোষকের হৃদয়।
আহমদ ছফা লিখেছেন—মধুদার নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে লম্বাচওড়া শালপ্রাংশু একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। মহাদেবের মতো চেহারা ছিল মধুদার। গায়ের রঙ একেবারে ধবধবে শাদা। তিনি রোদে রোদে ঘোরাফেরা করতেন বলে দেখাত একটু তামাটে।
দুই.
মধুসূদন দে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার প্রিয় ছিলেন ‘মধুদা’। এই মধুদা ২৬ মার্চ নিহত হন বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
২৫ মার্চের ভয়াল বীভৎস রাতের পরদিন সকাল। সন্ত্রস্ত প্রতিটি মুহূর্ত। বর্বর পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়িতে। মধুবাবু তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন শিববাড়ি কোয়ার্টারে। সেনারা মধুবাবুর বাড়ির দরজায় সজোরে করাঘাত করলে দ্বিধাসংকোচচিত্তে তিনি দরজার কপাট খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভেতরে ঢুকে পড়ে। মধুবাবুকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। পাশের বাড়ির আঙিনায় সেনারা তাঁকে আটকে রাখে। এঘর-ওঘর করে ছোটাছুটি করতে থাকেন মধুবাবুর পুত্রবধূ রানী। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা। অসহায় গৃহবধূর আর্তি প্রমত্ত হায়েনাকে এতটুকু বিচলিত করল না। স্বামী রণজিত দে ছুটে এলেন অসহায় স্ত্রীকে রক্ষা করতে। ক্রুদ্ধ বর্বরের উদ্যত রাইফেলের আঘাতে তারা লুটিয়ে পড়লেন। দাদা-বউদির কাছে ছুটে এল ছোট বোন রানু। সব ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী পরিবারের এই মেয়ে। আর সবাই ছোট ছোট। ওরাও দেখেছিল তাদের আপনজনকে বর্বর নরপিশাচদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে। নরপিশাচদের ভয়ে ওরাও প্রকম্পিত। অসহায় অবুঝ শিশু ওরা। সেদিনের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী ওরা। রানুই ছিল তাদের মধ্যে বড়। সে জানে সে দেখেছে নিজেও বর্বরদের শিকার হয়েছে। দাদা-বউদিকে রক্ষা করতে অবুঝ মেয়ে রানু ছুটে গিয়েছিল পাশের ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের গুলি তার চোয়ালে আঘাত করে।
রানু সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও রণজিত বাবু আর তার স্ত্রীকে হত্যা করে বর্বরেরা মধুবাবুকে আঙিনায় এনে দাঁড় করায়। একজন সেনা উঁচিয়ে ধরে রাইফেল। স্ত্রী শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গুলি ছুটে এল। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। গুলির আঘাতে হাত দুটো তার ঝাঁঝরা হয়ে গেল। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে প্রাণ দিলেন। গুলির আঘাতে মধুবাবুর দেহও জর্জরিত হয়ে গেল। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনি লুটিয়ে পড়লেন।
গুলির আঘাতে জর্জরিত মধুদা বর্বরেরা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ বেঁচে ছিলেন। ঘণ্টাখানেক পর আবার ওরা এসেছিল। ওরা মধুবাবুকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে ঘটনার ১৪ দিন পর্যন্ত শিববাড়িতে পড়েছিল মধুবাবুর ছেলে, পুত্রবধূ আর স্ত্রীর লাশ। মৃত্যুর সময় মধুসূদনের বয়স ছিল ৫৫ বছর।
তিন.
মধুর ক্যান্টিনের নামকরণ করা হয়েছিল এর প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে’র নামানুসারে। তবে মধুর ক্যান্টিন নামটি প্রচলিত হওয়ার আগে এর নাম মধুর স্টল, মধুর টি-স্টল, মধুর রেস্তোরাঁ নামেও পরিচিত ছিল। মধুর ক্যান্টিন নামে এটি শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লেও এর শুরুটা অনেক আগে থেকেই। আজকের মধুর ক্যান্টিন শুরুতে ছিল শ্রীনগরের জমিদারের বাগানবাড়ির নাচঘর।
মধুদার পিতামহ ছিলেন নকরী চন্দ্র। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিক্রমপুরের শ্রীনগরের জমিদারদের সাথে নকরী চন্দ্র্রের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যবসার উন্নতির কথা ভেবে নকরী চন্দ্র সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় তার ঠিকানা হয় জমিদার বাবুর জিন্দাবাজার লেনের বাসায়। তার দুই ছেলে ছিলেন আদিত্য চন্দ্র ও নিবারণ চন্দ্র। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নকরী চন্দ্রের ব্যবসা প্রসারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার বড় পুত্র আদিত্য চন্দ্রের উপর। তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাবার ব্যবসার প্রসার ঘটানোর। পিতার মৃত্যুর পর আদিত্য চন্দ্র স্থায়ীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাস শুরু করেন। নিজেদের গদি শক্ত রাখতে সরকারের নির্দেশে এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ ক্যাম্পাসের চারপাশের এলাকা থেকে ব্যারাক ও ক্যাম্প উচ্ছেদ করা শুরু করে। আদিত্য চন্দ্র তখন ৩০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে দুটি ছনের ঘর কিনে নেন এবং তার একটিতে বসবাস শুরু করেন।
মধুসূদন দের বয়স তখন ১৫ বছর। ১৯৩৪-৩৫ সালের দিক থেকেই মধুদা তার পিতা আদিত্য চন্দ্রের সাথে খাবারের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আদিত্য চন্দ্র্র মৃত্যুবরণ করলে মধুদা পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন। ব্যবসার কাজ দেখভালের পাশাপাশি তিনি তার বড় ভাই নারায়ণ চন্দ্রের পড়াশোনার খরচ বহন করতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে ডাকসু’র কার্যক্রম শুরু হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের পাশে মধুদার দায়িত্বে ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠিত হয়।
মধুদার আন্তরিক ব্যবহার ও সততার জন্য তিনি খুব অল্প সময়ের মাঝেই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। ক্রমেই মধুর ক্যান্টিন হয়ে ওঠে ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার আর এক পরম ভরসার স্থল। ’৪৮ এর ভাষা আন্দোলন, ’৪৯ এর বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৭০-র সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত আর যোগ্য নেতৃত্ব আসে এই মধুর ক্যান্টিন থেকেই। ১৯৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত বহু মিটিং হয়েছে এই ক্যান্টিনে। মিটিং এ গৃহীত সিদ্ধান্ত, সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ছাড়া শুধু মধুদাই জানতেন। সকলের খাওয়ার ব্যবস্থা মধুদা নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আর এভাবেই তৎকালীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলেনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল মধুর ক্যান্টিন।
মধুদা স্মৃতি সংসদ প্রকাশনী’র উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘মধুদা : শহীদ মধু সূদন দে স্মারক গ্রন্থ’ বইটি। এতে শিক্ষা এবং সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের অনেকেই মধুদাকে নিয়ে তাদের স্মৃতির কথা লিখেছেন। বইটির ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন—‘একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুর ভালবাসা আর অন্যদিকে মধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা-এসব কিছু পাকিস্তানিদের কাছে মধুকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল। ব্যবসায়িক লেনদেনের মাঝে এত চমৎকার ¯েœহ আর সম্প্রীতির সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠতে পারে? এখানে অবশ্যই সন্দেহজনক কিছু চলছে। মধুর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বই যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসার কারণ হয়ে উঠেছিল এসব কিছুই শত্রুদের বোধগম্যতায় আসে নি।’
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘মধুর ক্যান্টিনে তিনটি বড় টেবিল ছিল যেখানে প্রায় ৩০ জন বসতে পারত। এই তিনটি টেবিল অলিখিতভাবেই ঘোষিত ছিল তৎকালীন বিচক্ষণ ছাত্র নেতাদের জন্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা আইন বিভাগের সেই ছাত্রদের দখলেই টেবিলগুলো থাকত। দেশ বিভাগের আগে আমি সেখানে বিখ্যাত বামপন্থী নেতাদেরকেও দেখেছি যাদের মধ্যে ছিলেন এস. এম. আলী এবং মুনির চৌধুরী।’
তিনি আরও লিখেন—‘১৯৪৮ এর ১১ মার্চ এবং ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির কার্যক্রমের সকল পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি এই মধুর ক্যান্টিনে বসেই নেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর চোখে পড়ে যান মধু। এদের আক্রমণে বহুবার মধুর ক্যান্টিনে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।’
শুধু যে মুক্তমনা রাজনীতির কারখানা হয়ে উঠেছিল মধুর ক্যান্টিন তা-ই না। রাজনীতির পাশাপাশি তখনকার শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সংস্কৃতি সচেতন ছিলেন, যার প্রমাণ মেলে মধুর ক্যান্টিনে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতির চর্চাও চলত মধুর ক্যান্টিনে। সংস্কৃতি সংসদ এবং নাট্যকেন্দ্র’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শুরুটা হয়েছিল মূলত ৫০’র দশকের প্রথমার্ধে, ছাত্রদের চায়ের কাপের আড্ডায়। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আতিকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং জহির রায়হানের মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
চার.
মধুর ক্যান্টিন নিয়ে খুব প্রচলিত একটি কথা ছিল যে, এখানে না এলে যোগ্য রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। আরও একটি মজার ঘটনা আছে এই মধুর ক্যান্টিন নিয়ে। দোকানে বাকি রাখার যে রীতি, সেটি মোটামুটি সবারই কম বেশি জানা আছে। বাকির খাতা নামে একটি বিশেষ খাতাও থাকে দোকানে। মধুর ক্যান্টিনও এই ধারার ব্যতিক্রম ছিল না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা নেতৃত্বের বিশেষ আসনে আসীন হয়েছেন তাদের সহ রাজনীতিবিদদের অনেকেরই নাম ছিল মধুদার ‘না দিয়ে উধাও’ নামক খাতায়। অর্থাৎ এই খাতায় তাদের নামই লিখে রাখা হত, যারা খাবার খেয়ে কোনো কারণে টাকা পরিশোধ করতেন না। শিক্ষার্থীদের পকেটে তাৎক্ষণিক টাকা না থাকা, তবুও পরম স্নেহে মধুদার সেটা মেনে নেওয়ার মাঝে যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-নৈতিকতা ছিল; আজকের দিনে তথাকথিত ছাত্রনেতাদের গায়ের জোরে ‘ফাও’ খাওয়ার সাথে সেটাকে মেলাতে চাইলে ভুল হবে।
মধুর ক্যান্টিনে বসার জন্য বা আলোচনা করার জন্য প্রয়োজন ছিল সততা, যোগ্যতা আর বিস্তৃত বিষয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে অর্জিত স্বচ্ছ জ্ঞান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন অপেক্ষায় আছে সময়ের সেসব সাহসী সন্তানদের জন্য।