আজিম বাপ্পি
২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:২৩ পিএম
১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেরও বেশি সময় আগের কথা। তৎকালীন সুবিস্তৃত ইরানি মালভূমিতে বসবাস ছিল বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠীর। গরু, ছাগল ও ভেড়া চড়ানোই ছিল তাদের প্রধান পেশা। এমনই একটি গোষ্ঠীর প্রধান দ্বিতীয় সাইরাস। ইতিহাসে ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য অঞ্চলে বসবাসরত গোত্রগুলোকে একত্র করা শুরু করেন তিনি। সক্ষমও হন অনেকটা। একীভূত গোত্রগুলোকে নিয়ে জয় করেন পারস্যের উত্তরাংশে অবস্থিত শক্তিশালী মেদেস রাজ্য। এরপর মাত্র পনের বছরে সেই রাজ্যকে পরিণত করেন শক্তিশালী সাম্রাজ্যে।
অবশ্য সাম্রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ এই রাজা ছিলেন দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান প্রাচীন পারস্যের প্রথম সাম্রাজ্যকে। বর্তমান আধুনিকতার সময় যেমন সবদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে সাধারণ সৈন্যের পাশাপাশি বিশেষ ইউনিট থাকে ঠিক তেমনই দুর্ধর্ষ বাহিনী ছিল তার। বলা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বিশেষ সেই বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন তিনি। যাদের প্রধান কাজ ছিল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা দেওয়া। এছাড়া সাম্রাজ্য বিস্তারেও অবিশ্বাস্য ভূমিকা ছিল বিশেষ এই বাহিনীর।
রাজা সাইরাসের বিশেষ সেই সামরিক ইউনিটের নাম ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’। যদিও বিতর্ক রয়েছে এই নামকরণ নিয়ে। ইতিহাসবিদদের মতে— প্রথমে বিশেষ এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আনুসিয়া’ (Anusiya)। যার বাংলা অর্থ সঙ্গী। তবে বলা হয়ে থাকে— সাইরাসের এই কমান্ডো বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। অভিযানের সময় এই বাহিনীর কোনো সৈন্য আহত কিংবা নিহত হলে সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ সৈন্য দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা হয়। অর্থাৎ মূল ১০ হাজার সৈন্যের বিশেষ ইউনিটের পেছনে আরেকটি ছোট বাহিনী প্রস্তুত রাখা হত সবসময়। এতে একজন যোদ্ধা আহত বা নিহত হলে অন্যজন দিয়ে তা পূরণ হতো। ফলে বিশেষ এই বাহিনীকে সহজে দমানো যেত না। আর এভাবেই তাদের নাম হয়ে ওঠে ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’।
‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা নিয়েও বিতর্ক করেন কেউ কেউ। কোনো ইতিহাসবিদের মতে— বিশেষ এই কমান্ডো বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন পান্তিয়া আর্তেশবদ নামে এক নারী কমান্ডার। যাকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবিলনে পাঠিয়েছিলেন রাজা সাইরাস। বিতার্কিকদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোর কাছ থেকে ব্যবিলনকে রক্ষা করতেই বিশেষ এই বাহিনী গঠন করেন পান্তিয়া। তবে বিখ্যাত গ্রিক ইতিহাসবিদ জেনোফোন দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস গঠনের কৃতিত্ব দেন ‘কিং অব দ্য কিংস‘ সাইরাসকেই। তার মতে, আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা সাইরাস তার সেনাবাহিনী ‘দ্য স্পাডা’র সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সেনাদের নিয়ে এই ইউনিট গঠন করেন। সেসময় তাদের প্রধান কাজ ছিল রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
তবে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যার নামই আসুক সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে এই বাহিনীকে কাজ লাগিয়েছেন রাজা সাইরাস ও তার উত্তরসূরীরা। তাদের ব্যবহার করা হয়েছে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও যুদ্ধক্ষেত্রের গতিপথ পাল্টে দিতে। যেকোনো ইতিহাসবিদ অকপটে স্বীকার করেন প্রায় দুইশত বছর টিকে থাকা আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের সফলতার পেছনে এই ইউনিটের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালসের সৈন্য বাছাই প্রক্রিয়া
মূলত এই সামরিক ইউনিটের সদস্য বাছাই করা হতো পারস্যের অধিবাসীদের মধ্যে থেকে। গুরুত্ব দেওয়া হতো সমাজের সবচেয়ে অভিজাত ব্যক্তিদের। মিডিয়ান ও এলামাইট রাজ্য সাইরাসের অধীনে চলে এলে এই দুই রাজ্য থেকেও সদস্য নেওয়া হতো। যদিও রাজ্য দুটি সাইরাসের শত্রু ছিল। ফলে প্রশ্ন ওঠে রাজ্যগুলো থেকে নেওয়া সদস্যদের বিশ্বস্ততা নিয়ে। কিন্তু এই ইউনিটে তাদের উপস্থিতির বিবেচনায় রাজা সাইরাস বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি পাত্তা দেননি।
বিষয়টি পরবর্তী সময়ে ক্ষতির কারণও হয়নি। আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের পুরো দুইশত বছরের ইতিহাসে দেখা যায়— একসময় যেসব রাজ্য সাইরাসের বিরোধিতা করেছিল, জয়ের পর সেসব রাজ্য থেকে নেওয়া সদস্যরা কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। এর কারণ খুব নিখুঁতভাবে নিয়োগ দেওয়া হতো তাদের। প্রাধান্য দেওয়া হতো সামরিক ইউনিটের মানের বিষয়টি। সবকিছু বিবেচনায় সাম্রাজ্যের সৈন্যদলে যুক্ত হতে চাওয়া শিশুদের প্রশিক্ষণ শুরু হতো পাঁচ বছর বয়স থেকে। প্রথমে ঘোড়ায় আরোহন, শিকার ও তীর ছোড়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া হতো তাদের। ২০ বছর বয়সে নিয়োগ পেতো ‘দ্য স্পাডা’ বাহিনীতে। এই বাহিনীর সৈন্যদের মধ্য থেকে চারিত্রিকভাবে দৃঢ় এবং সামরিক দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে যাওয়া হত বিশেষ বাহিনীতে। তবে খুব বেশি নয়, আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের মোট সৈন্যের মাত্র ১০ শতাংশ ছিল এই বাহিনীর সদস্য।
দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস বাহিনী যেসব অস্ত্র ব্যবহার করত
পারস্য সাম্রাজ্যের বিশেষ এই বাহিনীর ব্যবহৃত অন্যতম অস্ত্র ছিল ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের বর্শা, যার সামনের দিক ছিল অত্যন্ত ধারালো। এর পেছনের দিক ছিল গোলাকার, অনেকটা আপেলের মতো। ইমমর্টালস ইউনিটের সদস্যরা মাথায় এক ধরনের মুখোশ পরতেন। এর নাম ছিল তিয়ারা। বাতাস ও ধুলো থেকে রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করতো মুখোশটি। এছাড়াও এই বাহিনীর সদস্যরা বিপুল স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা করে খাবার বরাদ্দ ও দাসদাসী নিয়োজিত থাকত। সমাজে তাদের খুব সম্মানের চোখে দেখা হতো।
ইতিহাসে রাজা সাইরাসের যুদ্ধ কৌশল
যুদ্ধে সাইরাসের সেনা সদস্যদের মধ্যে সামনে থাকত তিরন্দাজরা। এরপরই ইমমর্টালসদের অবস্থান। তিরন্দাজরা যেন নির্বিঘ্নে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে সেই কাজে সহায়তা করত বিশেষ বাহিনীটি। আর ঠিক তাদের পাশেই থাকতো অশ্বারোহীরা।
মিডিস, লিডিয়া ও ব্যবিলন— যেকোনো রাজ্যজয়ে বিশেষ ভূমিকা ছিল সামরিক এই ইউনিটের।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৫ সালে সাইরাসের ছেলে রাজা দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসিসের কাছে পরাজিত হন মিশরের ফারাও তৃতীয় সামতিক। পেলুসিয়ামের সেই যুদ্ধে তৎকালীন ফারাওকে পরাজিত করতে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছে ইমমর্টালস বাহিনী। সেই যুদ্ধজয়ে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আকেমেনিদ সাম্রাজ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইরাস বাহিনীর উৎকর্ষ দেখে সিনাই ও জুদিয়ার আরব ও সাইপ্রিয়টরা মিত্রতা স্থাপনের প্রস্তাব দেয় রাজা সাইরাসকে। সিন্ধু ও পাঞ্জাবজয়েও এই সামরিক ইউনিটকে ব্যবহার করেছেন সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট দারিয়ুস।
আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের প্রসারে সবসময় দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস ইউনিটের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। রাজা সাইরাসের হাত ধরে যাত্রা শুরুর পর থেকে দুইশত বছর সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল বাহিনীটি। বিভিন্ন যুদ্ধে নিজেদের সবটুকু দিয়ে সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করার গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। আকেমেনিদ সমাজে মর্যাদা বেড়ে যায় বিশেষ এই ইউনিটের সদস্যদের। নির্ধারিত সময় পর অবসরে গেলে সৈন্যদের জীবনযাপনে যেন সমস্যা না হয়, সেজন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে তাদের পর্যাপ্ত ভাতা ও জমির মালিকানা প্রদান করা হতো। বিশেষ মূল্যায়ন ছিল দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস ইউনিটের সদস্যদের।