ফিচার ডেস্ক
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৩ এএম
সাইবেরিয়ার দিগন্ত বিস্তৃত বরফের চাদরে ঢাকা এক শহর ইয়াকুৎস্ক। তীব্র হিমাঙ্কের কামড় আর হাড়কাঁপানো বাতাস যাদের নিত্যসঙ্গী, সেই শহরের বাসিন্দাদের প্রতি বছরই লড়াই করতে হয় চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে। চলতি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শহরটির তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৫৬ ডিগ্রি নিচে নেমে গিয়ে জনজীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, এই তাপমাত্রা শিগগিরই মাইনাস ৬০ ডিগ্রিতেও নামতে পারে।
হাড়কাঁপানো শীতের পরিসংখ্যান
পারদের মাত্রা ১০-এর নিচে নামলেই যেখানে স্বাভাবিক জনজীবন জবুথবু হয়ে যায়, সেখানে ইয়াকুৎস্কে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান হিসেবে পরিচিত ‘দ্রাস’-এর তাপমাত্রা মাঝে মাঝে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি ছুঁলেও ইয়াকুৎস্ক তার চেয়েও অনেক বেশি শীতল।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এখানে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল মাইনাস ৬২.৭ ডিগ্রিতে, যা ছিল গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে সর্বকালের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৮৯১ সালে এখানকার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল মাইনাস ৬৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সাদা বরফে ঢাকা জনজীবন
তীব্র তুষারঝড় আর কনকনে বাতাসের কারণে এই শহরে বাড়ির বাইরে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাইরে পা দিলেই চোখের পাপড়ি, ভ্রু, গোঁফ কিংবা দাড়ি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বরফে জমে সাদা হয়ে যায়। পোশাক ঢেকে যায় বরফের আস্তরণে। মাইনাস ৪০ ডিগ্রির নিচে বাইরে ১০-২০ মিনিটের বেশি অবস্থান করলে দেহ অসাড় হয়ে প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি হয়। তবুও সব বাধা জয় করে এই শহরে বাস করছেন প্রায় ৩ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ।
‘বাঁধাকপি’র মতো পোশাকই জীবনরক্ষা
নিজেদের দেহকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাতে এখানকার বাসিন্দারা ‘বাঁধাকপি’র স্টাইলে স্তরে স্তরে পোশাক পরেন। উলের মোটা কয়েক পরত পোশাকের ওপর হাঁটুর ওপর পর্যন্ত বিশেষ বুট জুতা, একাধিক দস্তানা এবং মুখ ঢাকতে অন্তত দুটি স্কার্ফ ব্যবহার করতে হয়। সামান্য অবহেলা মানেই এখানে নিশ্চিত বিপদ।
গাড়ি চলে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা
এই শহরের অদ্ভুত এক নিয়ম হলো, খোলা জায়গায় রাখা গাড়ির ইঞ্জিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। ইঞ্জিন বন্ধ করলে তেল এবং ব্যাটারি জমে গিয়ে গাড়ি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এই কারণে অধিকাংশ মানুষ গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করেন।

প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর ও জীবনধারা
পুরো ইয়াকুৎস্ক শহরটি দাঁড়িয়ে আছে ‘পারমাফ্রস্ট’ বা চিরহিমায়িত বরফ স্তরের ওপর। মাটির তাপে বরফ গলে গিয়ে যেন বাড়ি ধসে না পড়ে, সেজন্য এখানকার বাড়িগুলো খুঁটির ওপর নির্মাণ করা হয়। পুরো শহরটি যেন একটি আস্ত প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর। এখানে মাছ বা মাংস তাজা রাখতে কোনো ফ্রিজের প্রয়োজন হয় না; মাছের বাজারে মাছগুলো বরফের চাঁইয়ের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: পশু-পাখি এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যেতে কি পাসপোর্ট লাগে?
খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনীতি
তীব্র ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে এখানকার মানুষ ঘোড়া, বলগাহরিণ এবং খরগোশের মাংসের স্যুপ বেশি পছন্দ করেন। এখানকার প্রিয় খাবারের তালিকায় রয়েছে ঘোড়ার কাঁচা লিভার এবং পাতলা করে কাটা হিমায়িত মাছ। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি হলেও তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল। সোনা, ইউরেনিয়াম ও হিরার খনির কারণে তাদের আয় বেশ ভালো। তাই এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শহর ছেড়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।
প্রকৃতির সঙ্গে এক অদম্য লড়াই চালিয়ে ইয়াকুৎস্কের জীবনপ্রবাহ আজও সচল।
এজেড