বোরহান উদ্দিন
১৬ জুন ২০২৩, ০৯:০৫ এএম
‘সাফা ট্রাভেলস’ নামের একটি হজ এজেন্সির মাধ্যমে এবার হজ করতে সৌদি আরবে গিয়েছেন ভোলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার মাওলানা মো. ইয়াছিন। স্ত্রীসহ তার সঙ্গে ভোলা থেকেই কাফেলায় যুক্ত হয়েছেন দশজন। এই এজেন্সির মাধ্যমে মোট ১০৩ জন সৌদি পৌঁছেছেন গত ৪ জুনের ফ্লাইটে। ঠিকঠাক পৌঁছালেও ধারণার চেয়ে বেশি গরমে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত এই মাদরাসা শিক্ষক।
সার্বিক ব্যবস্থাপনা, প্রতিশ্রুতি মতো মক্কা-মদিনায় কাছাকাছি হোটেল পেলেও তার সঙ্গে যাওয়া অন্য হাজিরাও গরমের তীব্রতায় ভুগছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) মাওলানা মো. ইয়াছিনের ছেলে মো. হাসনাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। কিন্তু বাবাসহ অন্যরা গরমে একটু বেশি ভুগছেন। ফোন করে জানিয়েছেন রাস্তায় হাঁটলে মনে হয় নিচ থেকে তাপ উঠছে। আবার হোটেলের মধ্যে এসিতেও ঘেমে যাচ্ছেন। সতর্কতার সঙ্গে থাকার পরামর্শ দিয়েছি।
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে গরমের উত্তাপ অনেক বেশি। বিশ্বজুড়েও আবহাওয়ায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। সৌদির আবহাওয়া অধিদফতরও হজের সময় গরমের আগাম সতর্কতার কথা জানিয়েছে। তাই হাজিদের সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক ও হজ এজেন্সির মালিকরা।
জানা গেছে, এবারের হজে গরমের বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সৌদিতে হজ মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও অবগত আছেন। সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত হাজিদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। হাজিদের চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য সেখানে যাওয়া টিমকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সৌদি আরবে হজ মিশনে যাওয়া চিকিৎসকরা বিশেষ করে জোহর ও আসরের নামাজ হোটেল কিংবা বাসায় পড়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়া জুতা পায়ে হাঁটা, রোদে বের হলে ছাতা ব্যবহার, বেশি বেশি জমজমের ঠান্ডা পানি না খেয়ে নরমাল পানি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অসুস্থবোধ করলে দ্রুত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সৌদি গিয়ে কেমন আছেন হাজিরা
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন পবিত্র হজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবছর সারাবিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ মুসল্লি হজ করতে সৌদি যাবেন বলে জানা গেছে। আর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ২২১ জনের যাওয়ার কথা রয়েছে। গত ২১ মে থেকে শুরু হওয়া হজ ফ্লাইট শেষ হবে ২২ জুন। আর ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ২ জুলাই। শেষ হবে ২ আগস্ট।
তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার (১৪ জুন) পর্যন্ত সৌদি আরব পৌঁছেছেন বাংলাদেশের ৮২ হাজার ৩৩৫ জন হজযাত্রী। যাদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ৯ হাজার ৩৮৬ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ৭২ হাজার ৯৪৯ জন। সৌদি আরবের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে স্বয়ংক্রিয় চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৭৩০টি। এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে মোট ১৯ জন হাজি ইন্তেকাল করেছেন। যাদের মধ্যে পুরুষ ১৬ ও মহিলা ৩। এরমধ্যে মক্কায় মারা গেছেন ১৬ জন আর মদিনা ৩ জন।
এরমধ্যে কেউ গরমের তীব্রতা, কেউ আবার হৃদরোগ, বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ইন্তেকাল করেছেন। সৌদি পৌঁছা অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
হজযাত্রীদের গরমের তীব্রতার বিষয়টি জানা গেল এজেন্সির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে। জমজম ট্রাভেলস বিডি নামের হজ এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ শাকিল ঢাকা মেইলকে বলেন, এবার একটু গরম বেশি। অনেক হাজি গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রিও থাকছে। অনেকেই অসুবিধায় পড়ছেন। আমাদের একজন হাজির জ্বর এসেছে। হামও দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়া হাজিদের সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বেশি গরমের কারণে জোহর ও আসরের নামাজ হোটেল বা বাসায় পড়তে অনুরোধ করেছি। যারা বের হবেন অবশ্যই যেন ছাতা ব্যবহার করেন সেটাও বলে দেওয়া হয়েছে। কারণ সুস্থ না থাকলে সবকিছু ঠিকঠাক শেষ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
নীড় ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল গাফফার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এজেন্সি থেকে এ বছর ৩০৮ জন হজযাত্রী যাবেন। আগামী ২০ জুন এক ফ্লাইটে সবাইকে নিয়ে রওনা দেওয়ার দিন ধার্য আছে। কিন্তু এবার গরমের তীব্রতা বেশি থাকায় আমাদের সতর্কও থাকতে হবে। সেজন্য সবাইকে বাড়তি পরামর্শ হিসেবে ঠান্ডা-কাশির ওষুধ ও জ্বরের ওষুধ যেন অবশ্যই নেয়। প্রেসক্রিপশনসহ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও হজ মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে যে ডাক্তাররা যান তারাও হাজিদের সহযোগিতা করে থাকেন, ফ্রি ওষুধও দেওয়া হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
দীর্ঘ সময় ধরে হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সমস্যা হলো সৌদিতে দিনে অনেক গরম। আবার রাতে ঠান্ডা। এতে যারা বয়স্ক আছেন তাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। আর হাজিরা গরমের মধ্যে যখন জোহর ও আসর পড়তে যান, আবার ফিরে এসে এসি ছেড়ে দেন তখন ঠান্ডার সমস্যা বেড়ে যায়। তাই এবার বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে হাজিদের গরমের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ও অবহিত আছে জানিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (হজ) ড. মো. মঞ্জুরুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, এবার গরম কিছুটা বেশি। শুধু গরমের বিষয়টি নয়, হাজি সাহেবদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নিয়মিত ঊর্ধ্বতন স্যার এবং মিশনের কর্মকর্তারা কথা বলছেন। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করি সুন্দরভাবে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হাজিরা দেশে ফিরতে পারবেন।
কেমন থাকবে হজের সময়ের আবহাওয়া
এদিকে চলতি বছর হজ মৌসুমে মক্কা ও মদিনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের জাতীয় আবহাওয়া অধিদফতর।
দেশটির জাতীয় আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, জিলহজ মাসের প্রথম ১৫ দিন মক্কায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে ৪৩.৬ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হবে ২৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মদিনাতেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে ৪৩ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হবে ২৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জিলহজ মাসের প্রথম ১৫ দিন বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের থেকে বেশি হবে এবং জিলহজের বাকি দিনগুলোতে তা স্বাভাবিক থাকবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
এছাড়াও জিলহজ মাসে মক্কার আবহাওয়া দিনের বেলা কিছুটা শুষ্ক এবং রাতে মাঝারি থাকবে। মাঝে মাঝে ধুলো বাতাস বইবে। মদিনাতেও আবহাওয়া একই রকম থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
করোনার পরে বড় পরিসরে হজ হচ্ছে এবার
মাঝে করোনার কারণে হজে যেতে পারেননি অন্য দেশের মুসুল্লিরা। করোনার প্রকোপ কমার পর হজ শুরু হলেও এবার বড় পরিসরে হচ্ছে হজ। তথ্য অনুযায়ী, হাজিরা যেন নির্বিঘ্নে হজ সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য এবার ১৪ হাজার কর্মী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি সরকার। এদের সঙ্গে আরও ৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন হাজিদের সহযোগিতায়।
সৌদি সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মক্কা ও মদিনায় ৩০ হাজার বিতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিদিন অন্তত ২ মিলিয়ন লিটার, আর সব মিলিয়ে ৪০ মিলিয়ন লিটার জমজমের পানি বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও হাজিদের সুবিধার্থে মোবাইল অ্যাপস, রোবটসহ বিভিন্ন ডিজিটাল সুবিধা রাখছে সৌদি সরকার।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজিদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম সহজলভ্য করা এবং মেডিকেল সেন্টারে আসা রোগীদের সেবা দিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। চিকিৎসক দলের এক বা একাধিক চিকিৎসক, নার্স ও সহায়তাকারী সদস্য সমন্বয়ে ‘মোবাইল মেডিকেল ভিজিল্যান্স টিম’ গঠন করা হবে। যারা মক্কা ও মদিনার হজযাত্রীগণের আবাসিক ভবনে সরেজমিনে গিয়ে অসুস্থ হজযাত্রীগণকে প্রেসক্রিপশন দেবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো সদস্য কাজে অবহেলা করলে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিইউ/এএস