দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
১৬ জুন ২০২৩, ০৭:৫৬ এএম
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শফিকুল ইসলাম শাহীন হজ পালন করেন ২০১১ সালে। দীর্ঘ ৯ বছর পর ২০২০ সালে স্ত্রীকে নিয়ে আবার পবিত্র হজ পালনের পরিকল্পনা করেন। তখন বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার সাধারণ প্যাকেজ ছিল জনপ্রতি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি হজ এজেন্সিকে দুজনের জন্য ৬ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা হজে যাওয়ার আগমুহূর্তে দেওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারিতে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। এরপর থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন, সুযোগ পেলেই আবার যাবেন প্রিয় নবীর দেশে। করোনা মহামরি কেটেছে ঠিকই, তবে এ দম্পতির হজে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান হজ প্যাকেজ। চলতি বছর জনপ্রতি সর্বনিম্ন প্যাকেজ মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৭ টাকা। যা তিন বছর আগের খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আর এক যুগ আগের খরচ বিবেচনা করলে জনপ্রতি হজের ব্যয় বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি।
ঢাকা মেইলের সাথে আলাপকালে শফিকুল ইসলাম শাহীন বলেন, প্রথম যখন ২০১১ সালে হজে যাই আমার খরচ হয়েছিল ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। মক্কার কাছাকাছি থাকা এবং ভালো পরিবেশের জন্য এজেন্সিকে বেশি টাকা দিয়েছিলাম। সে বছর অনেকে ২ লাখ টাকাতেও হজ পালন করেছে।
খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার হজে যেতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, সামান্য সময়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে হজের খরচ। দুইজনের টাকায় একজন যাওয়া যাবে। স্ত্রীকে বলেছিলাম একা যেতে। কিন্তু তিনি আমাকে ছাড়া যাবেন না। শেষ পর্যন্ত একজনেরও যাওয়া হয়নি।
হজের প্যাকেজ মূল্য নিয়ে তিনি বলেন, সামর্থ্য থাকলে সব মুসলমানেরই বাসনা থাকে হজ পালনের। জায়গাটাই এমন যে একবার গেলে বারবার যেতে মন চায়। এখন কেউ হজ পালনের নিয়ত করলে বারবার ব্যয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়। হজ প্যাকেজ আরও সহনীয় হওয়া উচিত। বর্তমানে তা সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই।
তার দাবি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশের তুলনায় হজের খরচ কম। সর্বত্র ব্যয় বেড়েছে বলা হলেও মক্কায় ব্যয় সামান্য বেড়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, লাগামহীন বিমান ভাড়া দিয়ে যেতে হয় পবিত্র হজ পালনে।
২০১২ সালের হজ প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সে বছর হজ প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৪০ টাকা। যেখানে প্রতি মার্কিন ডলার ৮২ টাকা এবং প্রতি সৌদি রিয়াল ২১ টাকা ধরা হয়। এরমধ্যে বিমান ভাড়াসহ ইন্স্যুরেন্স সারচার্জ, জেদ্দা ডিপারচার ট্যাক্স, এম্বারকেশন ফি, এক্সাইজ ডিউটি বাবদ ১ লাখ ২৩ হাজার ৬২০ টাকা ধরা হয়। স্থানীয় সার্ভিস চার্জ ধরা হয় ৫শ টাকা। আপৎকালীন ফান্ড ১০০ টাকা, মোয়াল্লেম ফান্ড ২৪ হাজার ৩৯৯ টাকা। অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ১২ হাজার ৬০০ টাকা, মক্কা ও মাদিনার বাড়ি ভাড়া ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০৬টাকা। খাওয়া খরচ ১৮ হাজার ৩৭৫ টাকা এবং হজ গাইড ও প্রশিক্ষণ চার্জ ধরা হয় ৬ হাজার ৬০০ টাকা।
অন্যদিকে এবার (২০২৩ সালে) সরকারিভাবে হজে যেতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। আর বেসরকারিভাবে খরচ হবে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা।
২০২২ সালে সরকারিভাবে হজে যেতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। ওই বছর হজ প্যাকেজে ডলারের দাম ছিল ৯৪ টাকা, সৌদি রিয়ালের দাম ছিল ২৪ দশমিক ৩০ টাকা। এবার ডলারের দাম ধরা হয়েছে ১০৪ টাকা, সৌদি রিয়ালের দাম ধরা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছরে হজের খরচ দেড় লাখ থেকে ২ লাখ ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বিমানভাড়া বেড়ে যাওয়া, সৌদি আরবে খরচ বেড়ে যাওয়ায় হজ প্যাকেজের খরচ বেড়েছে।
২০২৩ সালের হজের খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারের হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৪ টাকা, জেদ্দা, মক্কা, মদিনা-মুজদালিফা পরিবহন ব্যয় ৩৫ হাজার ১৬২ টাকা। বাস সার্ভিস বাবদ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮৩৯ টাকা, জমজমের পানির দাম ধরা হয়েছে ৪২৫ টাকা। তাঁবু, বিছানা, চাদর, বালিশ কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবা ফি ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা। মক্কায় লাগেজ পরিবহন ৫৮৭ টাকা এবং মক্কা-মদিনা-আরাফাত-মুজদালিফা-মিনা-মক্কা বাসভাড়া ১৯ হাজার ৩৩৩ টাকা। দেশে ফেরার সময় মক্কা-মদিনা থেকে লাগেজ পরিবহন ৮৫১ টাকা, ভিসা ফি ৮৫১৭ টাকা। স্বাস্থ্য বীমা বাবদ সৌদি সরকারের ফি ৯৪৬ টাকা। আইডি কার্ড, আইটি সার্ভিস ইত্যাদি ৮০০ টাকা। হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল ২০০ টাকাসহ প্রশিক্ষণ ফি ৩০০ টাকা। এছাড়া খাওয়া খরচ ৩৫ হাজার টাকা ও হজ গাইড ১৫ হাজার ১৭৮ টাকা ধরা হয়।
হজের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, হজের খরচ নির্ভর করে মূলত দুইটা অংশে। একটা বাংলাদেশ অংশ, আরেকটা সৌদি অংশ। সৌদি অংশের যেটা খরচ সেটা সৌদি কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। হোটেল ভাড়া, খাবার, মোয়াল্লেম ফি- এটা বিশ্বের সবার জন্য একই। আর বাংলাদেশের খরচ বলতে শুধু বিমান ভাড়া।
হাব সভাপতি বলেন, সঙ্গত কারণেই কমলে শুধু বিমান ভাড়াটাই কমতে পারে। অন্য কোনো খাতে কমানোর কোনো সুযোগ নাই। আর প্যাকেজ মূল্য সারা বিশ্বেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কারণ হচ্ছে হজের সৌদি অংশের খরচ সেটা ডলার হয়ে রিয়ালে পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সেই খরচটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এশিয়ার বহু দেশে হজের খরচ বাংলাদেশের তুলনায় কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে যে কম খরচ বলা হয়, সেটার কারণ, মূলত অনেক দেশেই সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। যার ফলে খরচ কমে আসে।
তিনি বলেন, মূলত টাকার কনভার্সনের কারণে এই রেটটা বেশি পড়ে যায়। গত বছরই (২০২২ সালে) ১ ডলারের সেবার জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে ৮৮-৯০ টাকা হিসেবে। এবার দেখেন সেই জায়গায় ১১২-১১৫ টাকা হিসেবে খরচ করতে হচ্ছে। এখানেই তো বেড়ে গেছে।
ডিএইচডি