images

জাতীয়

‘ট্রায়ালের ভোট’ নিয়ে কেমন প্রস্তুতি ইসির?

বোরহান উদ্দিন

২২ মে ২০২৩, ১১:১৭ পিএম

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বড় পরিসরে ভোটের আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই ভোটে না থাকলেও গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চ্যালেঞ্জের মুখে আছে ইসি। নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে গাজীপুর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ‘ট্রায়াল’ করতে যাচ্ছে কমিশন। আগামী জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ৫ সিটির ভোট নিয়ে তাই জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে ইসি।

ইতোমধ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো ধরণের অনিয়ম পেলে গাইবান্ধার উপনির্বাচনের চেয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশাপাশি গাজীপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষ থেকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ভোটের দিনে নিজেদের ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যদিও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক রাখা, ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে উদ্যোগ নিতে হবে কমিশনকে।

City-Electionসাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ নেই। পার্টির লোকেরাও ভোটকেন্দ্রে যায় না। কারণ, তারা ভাবে আমাদের লোকেরাই তো জিতবে। নিউট্রাল নির্বাচন হলে কী করে ভোটারকে নিয়ে আসবেন- কেন্দ্রে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এই কাজ না করতে পারলে নির্বাচন কমিশন ফেইল করেছে বলতে হবে।

যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে শুধু গাজীপুর নয়, বরিশাল-খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচন যাতে প্রভাবমুক্ত ও সুষ্ঠু করা যায় সেজন্য বরাবরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি সদস্য মোতায়েন থাকবে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার মতো গাজীপুরসহ অন্য সিটির ভোটেও সব কেন্দ্রে থাকবে সিসি ক্যামেরা। যা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) নেতৃত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে পুরো কমিশন। কোনো ধরণের অনিয়ম নজরে এলেই নেওয়া হবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা।

City-Electionএদিকে, সিটি নির্বাচনের প্রথম ধাপে আগামী বৃহস্পতিবার (২৫ মে) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গাজীপুরের নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে এরই মধ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। সোমবার (২২ মে) দুপুরে এই কমিশনার গাজীপুরের ভোট নিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেকটা বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে। ঢাকায় বসে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার, কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা তা পর্যবেক্ষণ করবে। আমরা কোনো অভিযোগ দেখলে আইনে যেভাবে অ্যাকশন নেওয়ার কথা সেভাবেই নেওয়া হবে। গাইবান্ধায় তো কেবল নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। এখানে তার চাইতেও কঠিন অ্যাকশন হবে। আপনারা (সাংবাদিক) দেখেন।’

এর আগে গতকাল রোববার (২১ মে) গাজীপুরে ভোট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ‘ট্রায়াল’ হিসেবে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

কোন সিটির কী হাল?

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর ছাড়াও ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। এরমধ্যে গাজীপুর সিটিতে কেন্দ্র ৪৮০টি। এছাড়া খুলনায় ২৮৯, বরিশালে ১২৬, রাজশাহীতে ১৫২ এবং সিলেট সিটিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১৯০টি কেন্দ্রে।

তবে পাঁচ সিটির মধ্যে বেশি আলোচনা হয়েছে গাজীপুর ও বরিশাল নিয়ে। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল এবং তার মায়ের প্রার্থী হওয়া, প্রভাবশালী এই নেতাকে আজীবনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা, ভোটের প্রচারণায় বারবার বাধার মুখে পড়ার ঘটনা গাজীপুর সিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

City-Electionঅন্যদিকে বরিশালে সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন মনোনয়ন দেওয়ায় শুরুতেই ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’তে পরিণত হয় এখানকার নির্বাচন।

এর বাইরে সিলেটে বিএনপির সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নানা নাটকীয়তার পর ভোট না থাকার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে নির্বাচনের কর্মকাণ্ড শুরুর আগেই আলোচনায় জন্ম দিয়েছেন। তার ভোটে না থাকায় অবশ্য অনেকটা নির্ভার আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এছাড়া রাজশাহীতে সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, খুলনায় মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপি না থাকায় তারাও অনেকটা স্বস্তিতে আছেন। যে কারণে এই দুই সিটির ভোট নিয়েও নেই তেমন আলোচনা।

আচরণবিধি মানাতে ‘ঘাম ঝরেছে’ ইসির!

শুরুতে দফায় দফায় সতর্ক ছাড়াও শোকজ করেও আচরণবিধি মানাতে পারেনি ইসি। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিরোধী দলীয় উপনেতা ও প্রার্থী- কেউ আমলে নেয়নি ইসির নির্দেশনা। এমনকি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের লোকজনের বাইরেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বরিশালের মেয়র প্রার্থীকেও পড়তে হয়েছে শোকজের কবলে। অবশ্য, লিখিত জবাব দিয়ে পার পেয়েছেন চরমোনাই পীরের দলের এই প্রার্থী।

অন্যদিকে, গাজীপুরের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে দুই দফায় শোকজ করার পর ইসিতে এসে তিনি জবাব দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেই পার পেয়েছেন।

এর বাইরে সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীতে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরুর আগেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট চেয়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। অন্য দলের প্রার্থীরা এসব নিয়ে অভিযোগ দিলেও তা খুব বেশি আমলে নেয়নি ইসি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আগামীকাল মঙ্গলবার (২৩ মে) রাত ১২টায় শেষ হচ্ছে গাজীপুরের প্রচার-প্রচারণা। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সকাল ৮টা থেকে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হবে এই সিটির নির্বাচন।

City-Electionএই নির্বাচনে সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন টেবিল ঘড়ি মার্কা নিয়ে। তিনি প্রচারণা চালাতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। উল্টো কমিশন বলছে, তারা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাননি।

এ জন্য ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন জায়েদা খাতুন। এছাড়াও নির্বাচন পর্যবেক্ষণসহ সাত দফা দাবি জানিয়ে কূটনীতিকদের চিঠিও দিয়েছেন তিনি। রোববার (২১ মে) যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার বরাবর ইংরেজিতে তিন পাতার ওই চিঠি দিয়েছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের এই প্রার্থী।

যেমন থাকবে কেন্দ্রের নিরাপত্তা

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ সিটির ভোটে সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জনের আইন-শৃঙ্খলা সদস্য নিয়োজিত থাকবে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদের মধ্যে সাধারণ কেন্দ্রে চারজনের হাতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পাঁচজনের হাতে থাকবে অস্ত্র।

ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠির অনুলিপি ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলমকেও পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারে ১৯০টি মোবাইল ফোর্স, ৯৪টি স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োজিত থাকবে। সেই সঙ্গে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ১০০টি টিম এবং ৪৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হবে ভোটের এলাকায়। ভোটের আগে-পরে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা দায়িত্ব পালন করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

City-Electionএদিকে, নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতের জন্য ১৯০ জন নির্বাহী এবং ৫৪ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারকাজ সম্পন্ন করবেন। এছাড়া পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিজিবি-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় বিজিবি এবং নির্বাচনি এলাকার নিকটবর্তী নদীপথে দায়িত্ব পালন করবে নৌ-পুলিশ।

অন্যদিকে, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। সেই সঙ্গে নির্বাচনি এলাকায় সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে। প্রয়োজনে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করতে পারবে। আর পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে আনসার ও ভিডিপি।

কী বলছে ইসি?

সিটি নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে করা যায় এ জন্য অন্যসময়ের মতো এবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরেছে ইসি। যেখানে পুলিশ মহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে অন্যান্য সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ওই বৈঠকে ‘গাইবান্ধার উপনির্বাচনের মতো ভোট চান না’ বলে ইসির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই বৈঠকে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী সুষ্ঠু ভোটের জন্য সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।

অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনে গতবছর পুরো ভোট বন্ধ করে দিয়েছিল ইসি। পরে সেখানে নতুন করে নির্বাচন করতে হয়েছিল। যা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ইসিকে।

তবে এখন পর্যন্ত গাজীপুরের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো আছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি আছে, তাতে কেবল বাংলাদেশ নয়, এই সাবকন্টিনেন্টের কনটেক্সটে (উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে) অত্যন্ত ভালো আছে। নির্বাচনের দিন ফলাফল পর্যন্ত ভালো থাকবে।’

এর আগে সিটি নির্বাচনের ভোট নিয়ে ইসির প্রত্যাশার কথা জানিয়ে কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছেন, ‘পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ট্রায়াল হিসেবে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা গেলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দেশবাসী, রাজনৈতিক দল এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করবে।’

বিইউ/আইএইচ