বোরহান উদ্দিন
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:৪৩ পিএম
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২০টির বেশি জেলার মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। সেতুর কারণে সড়ক পথে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন। কিন্তু ঢাকায় প্রবেশ ও বের হতে গিয়ে এই পথের যাত্রীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কারণ গুলিস্তান এলাকার তীব্র যানজটে নাকাল হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
শুধু দূরপাল্লার যাত্রীদেরই নয়, ঢাকার ভেতরে চলাচল করা বেশিরভাগ যাত্রীকে প্রতিদিন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় গুলিস্তান এলাকার যানজটসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে।
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের ফুটপাত, সড়ক সবসময় থাকে হকারদের দখলে। ঢাকার ভেতরে চলা বাসগুলোর বেশিরভাগ গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া এলাকায় সড়কে রেখে দেয়ায় এমনিতেই যানজট লেগে থাকে। এরমধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে গুলিস্তান থেকে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলকারী দূরপাল্লার একাধিক পরিবহনের বাস।
সরেজমিন দেখা গেছে, ইমাদ, এনা পরিবহন, রয়েলসহ অনেক পরিবহনের বাস গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া হয়ে চলাচল করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলায়। এসব বাস আসা-যাওয়ার সময় সংকুচিত হয়ে যায় সড়ক। আর কখনো কখনো মূল সড়কের ওপর রাখার কারণে তৈরি হয় যানজটের।
বিশেষ করে যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়ার সময় এসব বাস যখন ঘোরানো হয় তখন পেছনে লম্বা যানজটের সৃষ্টি হয়। চলতি রমজানে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে গুলিস্তান এলাকায় তীব্র যানজট, মানুষ পায়ে হেঁটে চলবে সেই সুযোগও প্রায়ই থাকে না।
অবশ্য এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। একটি করে বাস সড়কে রাখার সুযোগ দিয়ে বাকিগুলো কোনোভাবেই সড়কে রাখতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সড়কে থাকা বাসটি যাত্রী নিয়ে যাওয়ার পর অন্য একটি বাস সড়কে দাঁড়াতে পারবে।
দূরপাল্লার কত বাস বাসা-যাওয়া করে গুলিস্তানে?
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে থেকে গুলিস্তান থেকে মাওয়া পর্যন্ত চলাচল করত বেশ কিছু বাস। কিছু বাস লঞ্চ পারাপার করত। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর গুলিস্তানে একে একে দূরপাল্লার পরিবহনগুলো আসতে থাকে। তবে পরিবহন কোম্পানি ও বাসের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একটি সূত্রে জানা গেছে, গাবতলী, মহাখালীর থেকে এখানে যুক্ত হওয়া ও একেবারেই নতুন করে আসা কোম্পানির সংখ্যা ৬০টির মতো। এসব পরিবহনের কম হলেও ৫ শতাধিক বাস প্রতিদিন যাত্রী আনা-নেওয়া করে গুলিস্তান থেকে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এসব বাস। ফলে দিনভর যানজটে স্থবির হয়ে থাকে গুলিস্তান।
ইমাদ পরিবহনের গুলিস্তানে পাঁচটি কাউন্টার রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন সাতক্ষীরা-শ্যামনগর-খুলনা-বাগেরহাট-মোরেলগঞ্জ, পিরোজপুর-গোপালগঞ্জ রুটে ৮০-৯০টি গাড়ি চলাচল করে বলে ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন গুলিস্তানের টিকিট বিক্রয়কর্মী মুরসালিন শেখ।
এনা পরিবহন কর্তৃপক্ষকে ফোন করে এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে তারা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বাসের সঠিক পরিসংখ্যান নেই ট্রাফিক বিভাগের কাছেও। ট্রাফিক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ৬০টি কোম্পানির কম হলেও ৫-৭শ গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু এদের তো এখানে আসার কথা না। কারণ এখানে বাস কাউন্টার নেই। ফুলবাড়িয়াকে কেন্দ্র করে এগুলো চলছে। ফলে গুলিস্তানে বাড়তি যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
নিয়মে পরিণত হয়েছে সড়কে বাস রাখা
শুধু দূরপাল্লার বাসই নয়, গুলিস্তান এলাকাজুড়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলায় চলা বাসও দিনভর দখল করে রাখে এই এলাকার সড়ক। বিশেষ করে গোলাপশাহ মাজারের পাশের ‘বাস বে’ সবসময় দখল করে থাকে নবাবগঞ্জ দোহার এলাকায় চলা একাধিক পরিবহনের বাস।
অন্যদিকে মাজার থেকে কিছুটা দক্ষিণে যাওয়ার পর টিএন্ডটি ভবনের দেয়াল ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে লেগুনা স্ট্যান্ড। পাশেই সবসময় সড়কে থাকে বিক্রমপুর চলাচলকারী যানবাহন।
এর ঠিক উল্টো পাশে অর্থাৎ পূর্ব পাশের সড়কে নবাবগঞ্জ-দোহারের আরাম, নগর পরিবহন, নবকলিসহ একাধিক পরিবহনের একাধিক বাস থাকে সবসময়। এসব বাসের কাউন্টারও মূল সড়কের ওপর।
অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ ও মাওয়ার দিকে চলা ইলিশ, গাংচিল পরিবহন রাখা হয় সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের আশপাশের সড়ক দখল করে। ফলে এদিক দিয়েও ভালোভাবে চলাচল করতে পারেন না পথচারীরা।
এই পথে নিয়মিত চলাচল করা রাশিম উদ্দিন নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, গুলিস্তানটাই দখল হয়ে গেছে। পুরো এলাকা মনে হয় বাসস্ট্যান্ড। অথচ যাদের দেখার কথা তারা দেখছে না। তার দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন দূরপাল্লার সব বাস ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গত মার্চে বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর জানিয়েছেন, রাজধানীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দূরপাল্লার বাসের সব কাউন্টার পর্যায়ক্রমে শহরতলীর টার্মিনালগুলোতে স্থানান্তর করা হবে। এছাড়া ঢাকার ভেতরে চাপ কমাতে মূল শহরের বাইরে বাসস্ট্যান্ড করার উদ্যোগও আছে।
বিআরটিএর যানজটপ্রবণ এলাকার তালিকায় গুলিস্তান
আসন্ন ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে বাড়িমুখী যাত্রীদের ৪৬টি স্পটে যানজটে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ২০টি ঢাকার ভেতর এবং প্রবেশ বা বের হওয়ার পথ। পাশাপাশি পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজায় একই অবস্থা সৃষ্টি হতে বলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
এসব স্থানে যানজট নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ। ঢাকা মহানগরীর মধ্যে রয়েছে মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল। বাকি এলাকাগুলো হচ্ছে এয়ারপোর্ট এলাকা, পোস্তগোলা ব্রিজ, বাবুবাজার ব্রিজ।
কি বলছে ট্রাফিক বিভাগ?
গুলিস্তান এলাকার যানজটের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি অনুষ্ঠানে আছেন বলে জানান।
পরে এই বিভাগের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানকার মানুষের কষ্টের বিষয়টি আমরা জানি। ঈদের সময় যাতে কষ্ট কিছুটা কমে সে জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যে আরও জোরেশোরে নামব। সড়কে কাউকে গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না।
বাস মালিকরা কি বলছেন?
বাস কাউন্টার নেই তবুও বাস রেখে যানজট বাড়ানোর বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর সঙ্গে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, এখানে যানজট বেশি হচ্ছে এটা ঠিক। তবে হাজার হাজার যাত্রী এখান থেকে আসা যাওয়া করছে এটাও ঠিক। এটা যাতে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা যায় সে জন্য আমাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রয়োজনে আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করব।
বিইউ/আইএইচ