বোরহান উদ্দিন
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২৫ পিএম
‘ঈদের কোনো চাপ দেখতেছি না। কবে হবে তাও বুঝতেছি না। কেবিন নিয়ে বসে আছি। কিন্তু কেউ তো চায় না।’ ঈদ কেন্দ্র করে লঞ্চের অগ্রিম টিকিট বিক্রির হালচাল জানতে টেলিফোন করলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান এমভি ইয়াদ লঞ্চের কারণিক আব্দুল হালিম।
ঢাকা-আমতলী রুটে চলা লঞ্চটির এই স্টাফের কথায় অনেকটা পরিষ্কার পদ্মা সেতু চালুর পর নৌপথে যাত্রী সংকটের চিত্র। শুধু এই রুট নয়, বেশিরভাগ রুটেই একই চিত্র।
ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চ এমভি মানামির পরিচালক আহম্মেদ জকি অনুপমের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, যাত্রী সংকট এত বেশি হবে কল্পনাও করতে পারিনি। ধীরে ধীরে সংকট এটা বাড়ছে। সবাই বাসে করে পদ্মা সেতু দিয়ে সবাই দ্রুত পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে যাচ্ছে।
তবে একদম শেষ সময়ে আগের মতো যাত্রীর চাপ শুরু হতে পারে- এমন আশায় আছেন লঞ্চ মালিকরা।
আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে বিক্রি শুরু হবে এবারের ঈদ উপলক্ষে লঞ্চের কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি। তবে চাইলে যে কেউ এখনো টিকিট নিতে পারছেন।
এদিকে যাত্রী খরার পাশাপাশি নৌপথে এবারের ঈদযাত্রায় হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের শঙ্কাও রয়েছে। যে কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বুলেটিনের ভিত্তিতেই লঞ্চ ছাড়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা।

ঈদের দুদিন আগের টিকিটের চাহিদা বেশি
নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক কবির হোসেন ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, ১৭ এপ্রিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে। গত ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৬৮টি লঞ্চ দক্ষিণাঞ্চলের ৪১টি রুটে চলাচল করত। তবে যাত্রী কমে যাওয়ায় এ বছর ৪৬টি লঞ্চ চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাত্রী চাপ বাড়লে লঞ্চ বাড়ানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
লঞ্চমালিক ও বুকিং কাউন্টার সূত্রে জানা গেছে, ঈদে মানুষ বাড়ি ফিরবে ১৮-২২ এপ্রিল। আর কর্মস্থলে ফিরবে ২৪-২৯ এপ্রিল।
মূলত ১৭ বা ১৮ এপ্রিল থেকে ঢাকা থেকে বরিশাল, হুলারহাট, ইলিশাসহ বিভিন্ন রুটের অগ্রিম টিকিট কাটা শুরু হয়েছে। যাওয়ার জন্য ১৯ ও ২০ এপ্রিল আর ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরতে বরিশালে ২৪-২৯ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বেশি নিচ্ছেন যাত্রীরা।
ইয়াদ লঞ্চের কারণিক আবদুল হালিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন চাপ না থাকলেও আশা করছি ঈদের দুদিন আগের টিকেটের জন্য বেশি যাত্রী থাকবে। আবার ফেরার সময়ও ঈদের তিনদিন থেকে টিকিট বেশি প্রয়োজন হবে।
সব কেবিন বিক্রি হলেও ডেকের যাত্রী আশানুরূপ না হলে তেলসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বাদে লাভের মুখ দেখার সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন দীর্ঘদিন লঞ্চে চাকরি করা আবদুল হালিম।

চাপ বাড়লে লঞ্চ বাড়বে, কেবিন ভাড়াও বাড়ছে!
ঢাকা-বরিশাল রুটে এখন মাত্র ২-৩টি লঞ্চ চলাচল করে। এ রুটে ২০টির মতো লঞ্চ আছে। এর মধ্যে ১০টার মতো ঈদে চলতে পারে। অথচ পদ্মা সেতু চালুর আগে ২০টি লঞ্চে হতো না। স্পেশাল ট্রিপও দিতে হতো।
ভোলার হাকিমুদ্দিন রুটে চলা লঞ্চের স্টাফ মো. মামুন ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন তেমন চাপ দেখি না। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে যারা যাবে তাদের কেউ কেউ অগ্রিম টিকিট নিচ্ছেন। তবে ২৫ রোজার দিকে বোঝা যাবে। যদিও ভোলার রুটে যাত্রী আছে।
মানামি লঞ্চের পরিচালক অনুপম ঢাকা মেইলকে বলেন, এবারও যাত্রী সংকটের দুশ্চিন্তা আছে। বিশেষ করে ডেকের যাত্রী অনেক কম হবে, এটা নিশ্চিত। কারণ অনেক ভালো ভালো বাস নেমেছে। মানুষ দ্রুত যাওয়ার জন্য বাসে যাতায়াত করতেছে। তবে ঈদের আগে কেবিনের যাত্রী পাওয়া যাবে। বিশেষ করে যারা পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি যাবেন তারা কেবিন খুঁজছেন।
এসময় তিনি জানান, খরচ কিছুটা কমাতে ঢাকা-বরিশাল রুটে কেবিন ভাড়া কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগে সিঙ্গেল ১ হাজার টাকা ছিল, সেটা ১২০০ টাকা আর ডাবল কেবিন ১৮০০ টাকার জায়গায় ২০০০ টাকা করা হচ্ছে। আর ভিআইপি ও ফ্যামিলি কেবিনে আগের চেয়ে ১ হাজার টাকা বাড়ানো হবে।
একই কথা শোনা গেল ঢাকা-বরিশাল রুটে চলা আরেক বিলাসবহুল লঞ্চ অ্যাডভেঞ্চারের মালিক ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক নিজাম উদ্দিনের কণ্ঠে।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ঈদে যাত্রী পরিস্থিতি যেমন ছিল সে তুলনায় এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ। হয়তো কেবিনে যাত্রী পাওয়া যাবে, তবে তাদেরও একটি অংশ নিজস্ব গাড়ি দিয়ে তিন ঘণ্টায় বরিশাল চলে যাবে। সব মিলিয়ে আপাতত ভালো খবর নেই আমাদের জন্য। যারা স্বস্তিতে পরিবার নিয়ে ঈদ করতে চায় তাদের অনেকেই লঞ্চে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তাদের সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত।
ঢাকা-আমতলী রুটে সিঙ্গেল কেবিন ১২০০, ডাবল ২৪০০, ফ্যামিলি ৪০০০ আর ভিআইপি ৬০০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঈদের সময় এটি বাড়বে কিনা তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

কেমন প্রস্তুতি সরকারি সংস্থার?
এদিকে চাপ আগের তুলনায় কম হবে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও নৌপুলিশ।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানিয়েছেন, এবারের ঈদে লঞ্চে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম হবে বলেই ধারণা করছি। এ নিয়ে আমরা একটি সমীক্ষা করব, যেখানে লঞ্চঘাটে যাত্রীদের গোনা হবে- এবার ঈদে কত যাত্রী লঞ্চে ভ্রমণ করছেন।
এদিকে ঈদে নৌপথে স্বস্তির যাত্রার জন্য নৌপুলিশ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌপুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের নৌপথে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে নৌপুলিশ বদ্ধ পরিকর। ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে নৌপথে নৌপুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। আমাদের সদস্যরা সব নৌঘাট, নৌ টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করবে। নৌপথে নিরাপত্তা বিধানে নৌযানগুলোর চলাচলে নৌপুলিশের বিশেষ নজরদারি থাকবে।
আর যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নৌপুলিশ, জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএর সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। কালবৈশাখীর মৌসুম হওয়ায় লঞ্চমালিকদের সতর্ক করা হয়েছে।
আগের কালবৈশাখীর মৌসুমগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা, কর্মচারী ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম ও সচেতনতামূলক গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিইউ/জেএম