images

জাতীয়

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রযাত্রা ও জাফরুল্লাহ চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০৮ এএম

দেশে যে কয়টি শিল্প অত্যন্ত শক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ওষুধ শিল্প। পোশাক শিল্পের সাফল্যের পর ওষুধ শিল্পকে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য হিসেবে দেখছে। দেশে অতি প্রয়োজনীয় এ পণ্যের মোট চাহিদার শতকরা ৯৮ শতাংশ পূরণ হয় দেশিও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্তত ১৪৮টিরও অধিক দেশ রফতানি করা হয় এসব ওষুধ। যার ভিত গড়ে উঠে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির মাধ্যমে। 

এর আগে বিদেশ থেকে প্রচুর টাকার ওষুধ আমদানি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হতো। ১৯৮২ সালে যখন প্রথমবারের মতো জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়ন করা হলো, তখন এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা এর আগে ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে কোনো ধরনের নীতিমালা ছিল না। ওষুধ নীতি প্রণয়নের পর বিদেশি ওষুধের প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং দেশেই ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। যার অন্যতম রূপকার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। 

ওষুধ বাজারের সেকাল একাল
ওষুধ নীতি প্রণয়নের আগে ১৯৮২ সালের দিকে ১৬ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হতো। আর ৮৪ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হতো। ওষুধের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ৮টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বেশ কয়েকটি কোম্পানির এ দেশে কোনো কারখানা ছিল না। তারা অন্য কোম্পানির কারখানায় ওষুধ বানিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড লাগিয়ে বাজারজাত করত। এতে নিম্নমান ও নকল ওষুধের ছড়াছড়ি ছিল বাজারে। বাজারে শতকরা ৩০ শতাংশ ওষুধ ছিল নিম্নমানের। একই সঙ্গে ওষুধ আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হতো বাংলাদেশের। 

১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির ১২টি নিয়ন্ত্রণকারী পদক্ষেপের কারণে বাজার থেকে বিদেশি ১ হাজার ৭০০টি ওষুধ বাতিল হয়ে যায়। ওষুধ প্রশাসন দুই সপ্তাহের মধ্যে রেসিপি পাস করতে শুরু করে। ফলে দেশি কোম্পানিগুলো ওষুধ বানানো শুরু করে। এতে ওষুধের বাজারে তড়িত ফল দেখা যায়।  কোনো কোনো ওষুধের দাম এক–তৃতীয়াংশ কমে যায়। একই সঙ্গে দেশে ওষুধ আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। নামহীন ও ছোট অনেক দেশি কোম্পানি বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়। সারাদেশের মানুষ অল্প দামে মানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়া শুরু করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার উপরে এবং আন্তর্জাতিক বাজার ৬৫০ কোটি টাকারও বেশি। দেশে বছরে এখন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে। এই শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দুইলাখ মানুষের। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৯ শতাংশের উপরে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে সরকারি তালিকাভূক্ত ছোট-বড় এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কারখানা রয়েছে ৮৫০টি। ওষুধ প্রস্ততকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৬৯টি।

স্বাস্থ্যনীতি ও ডা. জাফরুল্লাহ
ওষুধ নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্দেশে ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।  কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় পিজি হাসপাতালের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পরিচালক অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

এ বিষয়ে একটি বেসরকারি গণমাধ্যমকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি বলেছিলেন, ‘ষাটের দশকে আমি বিলেতে ভাস্কুলার সার্জন হিসেবে কাজ করতাম। ওই সময় আমরা একটা খবর জেনে খুব হতাশ হয়ে পড়ি। যুক্তরাষ্ট্রের টেরামাইসিন নামের যে ওষুধ বাজারে চলত, তা তৈরি হতো পূর্ব ইউরোপের একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে। পশুর ওষুধ এবং টেরামাইসিন একই কারখানায় তৈরি হতো।’

ওষুধ নীতি নিয়ে নিজের কাজের অভিজ্ঞতার তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতারণার আরেকটি বিষয় চোখে পড়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। আমি তখন গ্রামে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। দেখতাম এক দিনের চিকিৎসার জন্য যারা ঢাকায় আসতেন, তাদের সাত দিনের উপার্জন শেষ হতো। যক্ষ্মার ওষুধ ব্রিটেনে দাম ছিল ৬ ডলার। সেই ওষুধের দাম বাংলাদেশে ৪৯ ডলার। বিচিত্রায় ওষুধ সাম্রাজ্যবাদ নামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের ওষুধের সার্বিক পরিস্থিতি আমি শেখ সাহেবকে বুঝিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, দেশে ওষুধের দাম কমাতে হলে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। তিনি পূর্ব ইউরোপ থেকে ওষুধ আমদানির ব্যবস্থা করেছিলেন। ওষুধ নিয়ে কাজ করা আমার অনেকটা নেশার মতো। জিয়াউর রহমানকেও আমি ওষুধের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। এরপর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওষুধ নিয়ে আমি কী করতে চাই জানতে চেয়েছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ শরীফসহ অনেকেই এরশাদের সঙ্গে কাজে না জড়াতে বলেছিলেন।’

রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাথের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘এরশাদ সাহেবকে বলেছিলাম, একটি যথাযথ কমিটির মাধ্যমে ওষুধ নীতি প্রণয়নের কাজটি করতে হবে। ৮ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তখনকার পিজি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। খুব কম সময় নিয়ে আমরা কাজটি করেছিলাম। ওষুধ নীতি প্রণয়নের কাজে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘সিলেকশন অব অ্যাসেন্সিয়াল মেডিসিন’ প্রকাশনাটি বিশেষ কাজে লেগেছিল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করা, ওষুধ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ বাজার থেকে বের করে দেওয়া।”

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে।  ২০২০ সালে ওষুধ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭২তম। যা সূচনা হয়েছে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির মাধ্যমে। 

এমএইচ/একে