পিয়াস সরকার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৭:৫১ পিএম
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!’- অতুল প্রসাদ সেনের এই গানটি শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে গানটির কথায় যে আবেগ-ভালোবাসা মিশে আছে, তা আমরা ক’জনই বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গৌরব করার মতো ভাষাটাই যে হারাতে বসেছে তার গৌরব! ভাষাকে হেয় করে আমরা বরণ করে নিয়েছি পাশ্চাত্যের মিশ্র ভাষাকে। ঠিক যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকারের মতো, নিজের মায়ের ভাষাটাকেই দিচ্ছি না গুরুত্ব! যেখানে আমাদের এই বাংলা ভাষাই বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর স্বীকৃত ভাষা।
রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। আমরা ছিনিয়ে এনেছি লাল সবুজের পতাকা। ইতিহাস বলে বিশ্বের অনেক দেশই নিজের দেশকে পেতে রক্ত দিয়েছে। তবে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা মায়ের ভাষার জন্য ঢেলে দিয়েছি বুকের তাজা রক্ত। এই গৌরবের ইতিহাস কারও অজানা নয়। আবার বিশ্বের শ্রুতিমধুর ভাষার তালিকার শীর্ষে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাংলা ভাষা। ২০১০ সালে একদল ভাষা গবেষক বাংলাকে এই সম্মানের স্থান দেন। আর শ্রুতিমধুর ভাষার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে স্প্যানিশ ও ডাচ ভাষা।
যেসব কারণে বাংলা স্থান পায় শ্রুতিমধুর ভাষার শীর্ষ স্থান
সরল স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণে নির্মিত শব্দ: বাংলায় খুব শক্ত এবং টেনে টেনে উচ্চারণ করা শব্দের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এই ভাষায় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণে সার্থক মিলনে শব্দের উচ্চারণ আরও মধুর হয়ে ওঠে। কাছাকাছি উচ্চারণের পার্থক্যের জন্যও বাংলা শব্দে রয়েছে আলাদা আলাদা বর্ণমালা। আবার একই উচ্চারণের জন্য ভিন্নধর্মী বর্ণ শব্দের উচ্চারণ আরও সহজ করে তোলার জন্য একই ধরনের উচ্চারণে ভিন্ন ধরনের বর্ণ আছে বাংলায় এবং সেগুলো নিয়মিত প্রয়োগ হয় এই ভাষায়। ‘শ, স, ষ’ ছাড়াও ‘ন, ণ’ ‘র, ড়, ঢ়’ ইত্যাদি বর্ণগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
শব্দের শেষে স্বরবর্ণের উপস্থিতি: বাংলা শব্দের শেষে স্বরবর্ণের দৃশ্যমান উপস্থিতি না থাকলেও এর একটি অদৃশ্য প্রভাব সবসময়ই আছে। যার কারণে প্রতিটি শব্দের মধ্যেই একরকমের অনুরণন তৈরি হয়, এর ফলে বাংলা ভাষায় মধুরতা তৈরি হওয়া অতিপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়। ইতালিয়ান, তেলেগু কিংবা স্প্যানিশ ভাষায় এই ধ্বনির প্রভাব থাকলেও বাংলা স্বরবর্ণের ধ্বনিগুলো বাংলা শব্দের শেষে সবথেকে বেশি শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে এবং ভাষা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো ভিন্ন ধ্বনির হয়ে যায়। যেমন সূর্য, বসন্ত, কর্ম- শব্দ তিনটি হিন্দি ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে সওয়ারগ, বাসান্ত, কারম- হিসেবে তিনটি আলাদা ধ্বনির শব্দ হয়ে উঠেছে।
আবার আবেগময় অভিব্যক্তির ঐশ্বর্য মানুষের প্রত্যেক অনুভূতি সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করার জন্য বাংলা ভাষায় রয়েছে একাধিক শব্দ। অন্য কোনো ভাষার শব্দভাণ্ডারে আবেগের এত সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটানোর এত বহুল উপাদান নেই। এই অনুভূতি প্রকাশ করার স্বাধীনতার কারণে ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলা ভাষাকে সবসময়ই উপরে তুলে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ- বাংলা ভাষায় ‘ইস’ কিংবা ‘ধুত্তরি’ ধরনের শব্দের প্রয়োগ অন্যভাষায় তুলনামূলক অনেক কম দেখা যায়।
সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার: সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি, ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দ বাঙালি আদলে বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ায় এই ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। বক্তা যাই বলতে চান ঠিক তা-ই যেন প্রকাশ করা সম্ভব হয় এই ভাষায়। তাই শব্দের প্রাচুর্যতা থাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রকাশের অবলীলায় বক্তা তার সূক্ষ্ম অনুভূতিও প্রকাশ করতে পারেন। যার জন্য পৃথক শব্দের একাধিক প্রয়োগ দেখা যায়। এইসব একাধিক শব্দের বহুল ধ্বনির কারণে বাংলা হয়ে ওঠে আরও শ্রুতিমধুর। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট এবং বোধগম্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এছাড়াও বাংলা শ্রুতিমধুর কিংবা শক্তিশালী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ভাষা বিজ্ঞানীরা। যেমন বাংলা ভাষায় শুধু ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি বাঙ্গালিদের যতটুকু শক্তি দেয়, অন্য কোনো ভাষার জনগোষ্ঠীদের কাছে এমন শব্দমালা খুব কমই আছে।
২০১০ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। এরপর গত ১২ বছরে তথ্য না মিললেও ধারণা করাই যায় এই সংখ্যা নেয়াহেত বেড়েছে বইকি, কমেনি। সম্পদশালী এই ভাষা নিয়ে আমরা কতটা আনন্দিত?
বাংলিশ ও হিন্দির প্রভাব
ভাষা গতিশীল। ভাষা বহমান। প্রতিবছরই ইংরেজি প্রবিধানে যেমন যুক্ত হয় বাংলা ভাষা। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক যেন মুদ্রার উল্টোপিঠ। গত দুই দশকে দেশ ও বিদেশে হয়েছে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। আর যার ফলে চর্চা বেড়েছে ইংরেজিসহ হিন্দির চর্চা। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে ঘটছে ভাষার বিকৃতি। যেমন, আমি আর ওয়েট করতে পারব না কিংবা তুমি কোন ক্লাসে পড়? আবার এই ভাষার বিকৃতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে ওয়েব রেডিওগুলো। যেমন তাদের সাধারণ সম্বোধনের সূচনাতেই থাকে- হ্যালো ফ্রেন্ডজ, কি অবস্থা।
আবার ইদানিং কালের ফেসবুকীয় ভাষা আরও ভয়াবহ। এখন ফেসবুকে বার্তা দেওয়া হয়- ‘k u’ অর্থাৎ k- কে u- you অর্থ দাঁড়ায় আপনি কে? আবার অনেকেই বলেন, ‘aj uni cls h na’ অর্থাৎ aj- আজ, uni- ইউনিভার্সিটিতে cls- ক্লাহ h- হবে na- না। মোট কথা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না।
পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্যাবল সংযোগ আসার ফলে বেড়েছে হিন্দি ভাষার চর্চা। ছোট বাচ্চাদের মাঝে এই প্রভাব বেড়েছে সবথেকে বেশি। ডোরেমন নামে একটি কার্টুন অনুষ্ঠানের চরিত্রের চর্চা দেখা যায় সবার মাঝে। সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখা যায়, ছেলে হিন্দিতে কথা বলছেন। তার মাকে প্রশ্ন করাতে তিনি উত্তর দেন, সারাদিন ডোরেমন দেখার কারণে তার এই অবস্থা। আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মীনা কার্টুনের পর্ব অনেক কম। এগুলা সব দেখা হয়েছে তাই অন্য কার্টুন দেখে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজির প্রভাব
বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বদল এসেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। এখন অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে অধিক চিন্তিত। আর শিক্ষাক্ষেত্রেও ঢুকে গেছে তিন মাধ্যমের লেখাপড়া। ইংরেজিতে যারা লেখা পড়া করেন তাদের বাংলা ভাষা চর্চা রীতিমতো শূন্যের কোঠায়। মোহাম্মদ প্রিপারেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী মৃনময়ী চৌধুরী। মৃনময়ীর বাংলায় কথা বলা বারণ। আর সে বাংলায় খুব কথাও বলতে পারে না। পোশাক ব্যবসায়ী বাবা তুহিন চৌধুরী বলেন, বাংলার প্রতি ভালোবাসা থাকাটা জরুরি। আর চারপাশে যেহেতু সে বাংলা শুনছে, প্রয়োজনে বলছে সেহেতু এটা শিখে গেছে। কিন্তু ইংরেজির চর্চাটা ধরে রাখলে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভালো হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কেউ যদি বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে তবে করণীয় কী? সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ একইভাবে অনুচ্ছেদ ২৩ বলছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করেছে ‘অ আ ক খ- আন্দোলন’। এর উদ্যোক্তা সাবেরুল ইসলাম বলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছে বিশ্বের আটটি দেশ ভ্রমণের। কিন্তু কোথায় যেন বাংলা নিয়ে আমাদের অহংকারবোধটার অভাব রয়েছে। রাশিয়ানরা তাদের ভাষার লোক পেলেই সে ভাষায় কথা বলে। কিন্তু আমরা কথা বলি হিন্দিতে। আমরা কেন হিন্দিতে কথা বলব। ভারত হিন্দি ছড়িয়ে দিয়েছে আমরা পারিনি।
তিনি বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলেই ভাষার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। যখন আমরা ভাষার প্রতি টান অনুভব করব, তখনই বাংলা গৌরব টিকে থাকবে। দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা না থাকায় সাইনবোর্ড তুলে ফেলছি আমরা, তাতে কি লাভ হচ্ছে? বরং আমরা ভাষাকে অস্ত্র করে তার ব্যবসার ক্ষতি করছি। ভাষা তখনই শ্রদ্ধা পাবে যখন দোকান মালিক বুঝতে পারবেন বাংলা সাইনবোর্ড না হলে ভাষাকে ছোট করা হবে।
বিদেশে বাংলাভাষী যারা
বিশাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুরোটাই বাংলাভাষীদের বাস। তাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাষার মিল থাকলেও পরিবর্তন এসেছে নানা উচ্চারণে। তারা স্বানন্দে বলে যান বাংলা ভাষায় কথা। ভারতে কলকাতা এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সেহ্নাশীষ দে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আমরাও উদযাপন করি। এটা ভিন্ন এক দেশে ভাষার জন্য লড়াই হলেও এটাই আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের বইতেও উল্লেখ আছে ভাষা আন্দোলনের কথা। ভাষায় নানা পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশের মতোই ইংরেজির আধিপত্য আছে। আর আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দি হওয়ায় এখানেই অনেক প্রভাব রয়েছে।
পাকিস্তানেও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তারা মূলত বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারত থেকে ধর্মের কারণে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন বা আটকা পড়েছিলেন। তারা নানা ধরণের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও বাংলা ভাষা ব্যবহারে কোনো বাধার সম্মুখীন হন না। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী আফওয়ান সাদ থাকেন আমেরিকায়। তিনি সম্প্রতি করাচিতে এক মাসের একটা সেশনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি অবাক হয়েছি জেনে যে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স করানো হয়। সেখানে মূলত বাংলার জগতবিখ্যাত উপন্যাসগুলো নিয়ে আলোকপাত করা হয়।
আফওয়ান সাদ বলেন, পাকিস্তানে বাংলা ভাষীদের একটা কমিউনিটি আছে। তাদের বাংলা বলা নিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। এছাড়াও বাংলাভাষী ও উর্দুভাষীরাও ভাষার ইতিহাস জানেন কিন্তু আমরা যেভাবে জানি সেভাবে না। আমি এক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম ’৫২ ও ’৭১ নিয়ে। তিনি জবাবে বলেন, আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতার আন্দোলন। পাকিস্তান যা করেছে নিজেদের রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে এতে অন্যায়ের কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, সবস্থানে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ থাকে তারাই মূলত কিছুটা বাড়াবাড়ি করেছে যুদ্ধের সময়।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরে মাইডিন নামে একটি বাঙ্গালি মার্কেট আছে। এই মার্কেটের আশপাশে প্রায় অধিকাংশই বাংলাদেশিদের দোকান। এই বাজারে নেপালি এক দোকানদার বাংলায় কথা বলে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন ক্রেতাদের। জানতে চাইলে তিনি জানান, এখানে সব বাঙ্গালি ক্রেতা বেশি আসে। তাই বাংলা আয়ত্ব করেছেন তিনি। নেপালি ভাষা ও বাংলার মাঝে অনেক মিল রয়েছে তাই আয়ত্ব করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তার।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. মিলন খান বলেন, আমরা দেশে থাকা অবস্থায় বাংলার মর্ম বুঝতাম না। এখানে অনেক ভিনদেশি আছেন যারা আমার কাছে বাংলা গুটিকয়েক শব্দ বা বাক্য শিখেন। হ্যাঁ, ভিনদেশি ভাষা নিয়ে সকলের আগ্রহ থাকে। কিন্তু আমাদের ভাষার জন্য লড়াইয়ের কারণেই তাদের আগ্রহটা অনেক বেশি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশিরা সাধারণ কেমন আছো? ভালো আছো? ধন্যবাদ, মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি- এসব কথা অধিক হারে শিখতে চায়।
বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমেও ছাড়াচ্ছে বাংলা। সুদানে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ফেরা এক সদস্য বলেন, তারা আমাদের ভাষাটাকে নিজেরাই রপ্ত করার চেষ্টা করে। এতে তাদেরও উপকার হয় আমাদেরও। তিনি বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে আমরা যখন যেতাম তারা আমাদের সঙ্গে আধো আধো বাংলায় কথা বলতেন।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে থাকা বিদেশি অনেকেই বাংলা ভাষা রপ্ত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা ইন্সটিটিউটে এক মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। বুকিত বাকিত নামে ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি ও আমার স্বামী বাংলাদেশে চাকরি করি। আমরা বাংলাদেশে ৬ বছর থাকব। তাই ভাবলাম ভাষাটা শিখে রাখি। বাংলা আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে মা ডাকটা।
যেভাবে এলো বাংলা ভাষা
আজকের বাংলা ভাষা একদিনে আসেনি। শত সহস্র বছরের বিবর্তনের এই রূপ বাংলা ভাষা। ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেছেন, সংস্কৃত থেকে নয়, প্রাকৃত ভাষা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বাংলা ভাষার। সংস্কৃত ছিল সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষের লেখার ভাষা। তা কথ্য ছিল না। কথা বলত মানুষেরা নানা রকম ‘প্রাকৃত’ ভাষায়। প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথ্যভাষা।
তিনি আরও বলেছেন, প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে মনের ভাব প্রকাশের নানা রীতি চালু ছিল। সেখান থেকে অঞ্চলভেদে উৎপত্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতভাষা। আমাদের এই নদী বিধৌত পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা যে প্রকৃত ভাষায় কথা বলতে, তা হলো মাগধী। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা মাগধি রূপান্তরিত হয়ে বাংলাভাষার উদ্ভব হয়।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বাংলা, আসামি ও ওড়িয়া ভাষা। তাই বাংলার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আসামি ও ওড়িয়ার। আর কয়েকটি ভাষার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে বাংলার সঙ্গে; কেননা সেগুলোও জন্মেছিল মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে। ওই ভাষাগুলো হচ্ছে মৈথিলি, মগহি, ভোজপুরিয়া। তবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একটু ভিন্নমত পোষণ করেন তিনি। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, গৌড়ী প্রাকৃতেরই পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ থেকে উৎপত্তি ঘটে বাংলা ভাষার।
আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো ভাষার নাম ‘প্রাচীন প্রাকৃত’। কালক্রমে এর অভিহিত হয় ‘আধুনিক প্রাকৃত’ রূপে। আধুনিক প্রাকৃত ভাষা থেকে শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে ‘গৌড়ী প্রাকৃত’, ‘মাগধী প্রাকৃত’ ইত্যাদি নামে আরও কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়। কালের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষার আরও পরিবর্তন হয়ে নাম হয় অপভ্রংশ। এই অপভ্রংশ থেকে জন্মলাভ করে আসামের ‘অহমিয়া’ ভাষা, উড়িষ্যার ‘উড়িয়া’ ভাষা, ভারতের ‘হিন্দী’ ভাষা এবং এতদাঞ্চলের ‘বাংলা’ ভাষা।
১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন ঘোড়-সওয়ার নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার পর শুরু হলো বাংলায় মুসলিম শাসন। তাতে মুক্ত হলো সংস্কৃতি, মুক্ত হলো ভাষা। তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কয়েকশত বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। এরপর বাংলায় যুক্ত হয় আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ।
ইংরেজ আমলেই ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বাংলাকে শিক্ষার বাহন করার জন্যও তিনি জোর দাবি জানান। এরপর ১৯১৮ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহ ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’
১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীনতা লাভে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টির পর বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার প্রভাব মুক্ত হয়। এরপরও কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটে।
ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর অন্য ভাষার প্রভাব বাংলা থেকে সরে গেলেও রাজনৈতিক চালে ভাষাটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা সেটি হতে দেননি। পিছপা হননি বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিতে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ পারভেজ চৌধুরী, পিএসসি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্বন্ধে সম্প্রতি এক লেখায় বলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্ন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে এর প্রতিবাদ করে ছাত্রসমাজ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই পরিষদের অন্যতম সদস্য।
নবগঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। বঙ্গবন্ধুসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। পাকিস্তানের গভর্নর মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন জিন্নাহ। তিনি ঘোষণা করেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানান, তুমুল প্রতিবাদধ্বনি উচ্চারিত হয় সেদিন থেকেই। জিন্নাহর ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের দ্বারা ভাষা আন্দোলন জোরদার হলেও পরবর্তী সময়ে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে ছাত্রদের মনোবল বেড়ে যায় এবং তারা এগোতে শুরু করে নির্দ্বিধায়।
দুই পর্বে বিভক্ত এই আন্দোলন ১৯৪৮ সালে অনেকটা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্র ভাষা-রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই-বাংলা চাই’ স্লোগানে ছাত্রসমাজ মিছিল বের করে, মুখরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালালে ভাষাশহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ সব বীর শহিদকে, যারা ভাষার জন্য, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। বাঙালির সাহসিকতার ইতিহাস আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। এর পেছনে মূলত ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনই হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের (ইউনেসকো) ১৬০তম অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেসকো প্লেনারি সেশনে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সর্বসম্মত এ স্বীকৃতি প্রদান করে, যা ছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন। এর মাধ্যমে ভাষার জন্য বাঙালি জাতির আত্মবিসর্জন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথম বারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। এরপর থেকে প্রতি বছরই ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর ‘শান্তির জন্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি রেজুলেশনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এটি তুলে ধরে। ভারত, জাপান, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের ১২৪টি দেশ এ রেজুলেশনটি সমর্থন করে। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ইউনেসকোর সদর দফতরসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে নিজ নিজ মাতৃভাষার আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিবসটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দিন।
বাংলা ভাষাচর্চার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, আজ আমরা স্বাধীনভাবে গাইতে পারছি, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বে (ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি) চর্চা হয়ে থাকে। এছাড়াও চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ২১টি দেশে কমবেশি বাংলা সংস্কৃতি চালু আছে। আমেরিকার নিউইয়র্ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া ও ভার্জিনিয়া শহরের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে রেডিওতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ব্রিটেনে বেতার বাংলা নামে রেডিও স্টেশন পরিচালনা করা হয় এবং নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকা পাওয়া যায়।
বর্তমানে এশিয়া ও আমেরিকার দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতেও বাংলা দৈনিক পত্রিকাসহ বাংলা ভাষায় রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বে বাঙালির মননের বাতিঘর হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়। একুশ এখন সারা বিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার ‘শহীদ মিনার’।
বাঙালি জাতি কেবল ভাষা আন্দোলন করেই ক্ষান্ত হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ জাতির মধ্যে যে চেতনার উদ্রেক হয়, উনসত্তর থেকে একাত্তরে তার চরম বিস্ফোরণ হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর শুধু ভাষাশহীদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় ভাষার জন্য লড়াই করা ২১। তখন থেকেই আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন- এই দুই ধারাকে একসূত্রে গেঁথে মুক্তিসংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। যে’কটি চেতনার উন্মেষে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সৃষ্টি, ভাষা আন্দোলনের সেই মোহনীয়তা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। বাঙালি দীপ্ত পথ-পরিক্রমা ধাপে ধাপে এগিয়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা রণাঙ্গনে।
বিশ্বমঞ্চে ভাষার সম্মান লাভ
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর এদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। এরপর থেকেই দিনটি পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব তুলে ধরেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম দেশ থেকে প্রবাসে থেকেও বাঙালির আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেই প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেছিলেন ভিন্ন ভাষাভাষী ১০ জন সদস্য। তবে জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টি নিয়ে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কোতে যোগাযোগ করা হয়।
এরপর পেরিয়ে যায় এক বছর। কোনো সিদ্ধান্ত না আসলেও কানাডাপ্রবাসী আরেক বাঙালি আবদুস সালামকে নিয়ে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। ইউনেস্কো থেকে জানানো হয়, বিষয়টি ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকটি দেশ থেকে প্রস্তাব পেশ করতে হবে।
রফিকুল ইসলাম যোগাযোগ করেন বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু উপেক্ষা করে ইউনেস্কোর সদর দফতরে পাঠিয়ে দেন সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাব। যেটি প্যারিসে পৌঁছায় ৯ সেপ্টেম্বর। তবে উদযাপনের খরচসহ কয়েকটি কারণে ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশন ও ৩০তম সম্মেলনে বিষয়টি আটকে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে সেখানে বেশ বড় ভূমিকা রাখেন শিক্ষামন্ত্রী ও ওই অধিবেশনের প্রতিনিধি দলের নেতা এ এস এইচ কে সাদেক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি অধিবেশনে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, দিবসটি উদযাপনে সংস্থাটির কোনো খরচ বহন করতে হবে না।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সেই মর্যাদা। ইউনেস্কোর সেই অধিবেশনে এই দিবস পালনের মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। তবে সমর্থন ছিল পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয় প্যারিসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করা হয়। সে বছর থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতেও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে কানাডার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটিকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। রফিকুল ইসলাম ২০১৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২০১৬ সালে রফিকুল ইসলামকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পদক’-এ সম্মানিত করা হয়।
বইমেলা
১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। যা সময়ের বিবর্তনে লাভ করে জাতীয় মেলার গৌরব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. হাকিম আরিফ বলেন, বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি। আমারা প্রথমবারের মতো ভাষা মেলার আয়োজন করেছি। ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারিতে সেগুনবাগিচায় ভাষা মেলা অনুষ্ঠিত হবে। আমরা বাংলাসহ বাংলাদেশের সকল ভাষার প্রসারে কাজ করে যাব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমদ বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সব বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালীর দেওয়া রক্ত আজ বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যা সম্ভব হয়েছে জাতির জনক ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ ইতিহাস আবহমানকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সূচনাই হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান হলো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নিষ্ঠকর্মী। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মোহ ভঙ্গ হলো। কলকাতার বেকার হোস্টেলে বসে সেই সময়েই তিনি সঙ্গীদের বলেছিলেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে বেশি দিন থাকা যাবে না। ঢাকায় ফিরে বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে হবে।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পড়তে হবে কে বলেছে? বিত্তবানের সন্তান ঠিকই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ইংরেজি না শিখলেও ভালো চাকরি পাচ্ছে। দরিদ্রের সন্তানকে বাধ্য করা হচ্ছে বাংলা মাধ্যমে পড়তে। তারা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ভালো চাকরি পাচ্ছে না। ভুল শিক্ষানীতির কারণে একটা শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা হয়েছে।
পিএস/আইএইচ