images

জাতীয়

কলাগাছ-কাঠের শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা আর কতদিন?

বোরহান উদ্দিন

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:২৬ এএম

একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস। ৭১ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউল, সালাউদ্দিনসহ নাম না জানা অনেকে।

সেই শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এখনও ভাষা শহীদদের প্রতি স্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পান না। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হলেও ভাষা শহীদদের স্মরণে তৈরি হয়নি কোনো শহীদ মিনার। ফলে শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে ভরসা হয়ে ওঠে কলাগাছ বা কাঠের তৈরি শহীদ মিনার।

ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পরেও দেশের কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, সেই পরিসংখ্যানও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে তথ্য মতে, প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এখনো নেই শহীদ মিনার।

যদিও ভাষা আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে উচ্চ আদালতের আদেশ রয়েছে। আবার ২০১৬ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরও (মাউশি) নির্দেশনা দিয়েছিল। তারপরও শহীদ মিনার নির্মাণ হয়নি দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে।

এমন বাস্তবতায় শিক্ষাবিদরা বলছেন, শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এতদিনেও শহীদ মিনার নির্মাণ না হওয়া দুঃখজনক।

দ্রুততার সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ করে এসব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপনের দাবি শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের।

M3

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছরেও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না হওয়া দুঃখজনক। মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়া শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সব শিক্ষার্থীর জানা উচিত। তাই তালিকা তৈরি করে যেখানে নেই যেসব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনারের হালচাল

শিক্ষা অধিদফতরের ২০১৯ সালের নভেম্বর সবশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৩ হাজার ৬০১টি। এরমধ্যে ২০ হাজার বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে বলে জানা গেছে। সে হিসেবে ৪০ হাজার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হয় কলাগাছ, না হলে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।

কোথাও আবার অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনাও আছে। কোথাও ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজনই থাকে না- এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮ হাজার ৯১০টি। এর মধ্যে স্কুল ১৮ হাজার ১৯৭টি, কলেজ দুই হাজার ৩৬৫টি, মাদরাসা সাত হাজার ৬১৮টি। এছাড়াও এবতেদায়ী মাদরাসা, কিন্ডারগার্টেন আছে হাজার হাজার।

২০২০ সালে শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া ভাষ্য অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্তরের ৩৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাড়ে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। আর ৬৩ হাজার ৬০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০ হাজারটিতে নেই শহীদ মিনার।

যদিও দেশে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ঠিক কতটিতে শহীদ মিনার আছে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই মাউশি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের কাছে।

সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করছেন, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা নিবেদনের খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ায় তারা বিব্রতবোধ করছেন।

মাউশির মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শাখার উপপরিচালক আজিজ উদ্দিন ও কলেজ শাখার উপপরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, শহীদ মিনার না থাকা প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) সাইফুল ইসলামেরও একই বক্তব্য।

তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শহীদ মিনার না থাকার বিষয় নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, শহীদ মিনার না থাকার তথ্য জানা আছে। ধাপে ধাপে সব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শহীদ মিনারের ডিজাইনও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের ৫০ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার। বিভাগের আট জেলায় ৯ হাজার ৫৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনার রয়েছে ৪ হাজার ৯২৫টিতে।

M2

ঢাকার পাশ্ববর্তী রাজবাড়ী জেলার ৮০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এই জেলায় ৭৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৮১টি। এরমধ্যে শহীদ মিনার আছে মাত্র ৫৬টিতে।

রাজবাড়ি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্দেশনা আছে। কিন্তু অনেক জায়গায় শহীদ মিনার নেই। চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং কমিটি এসব বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বছর কোনো ধরনের চাহিদা বা বরাদ্দের কথা জানা নেই।

অন্যদিকে বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলায় ১ হাজার ৬১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছোট-বড় মিলে মোট ১০৫টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের খুলনা জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা জেলা ও মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ১৫৯টি। এর মধ্যে ৯ শতাধিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই।

চট্টগ্রাম বিভাগের শুধু ফেনী জেলায় ৫৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮৮টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিজেরা অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা জানায়।

বিইউ/জেএম