মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:৪৯ এএম
রাত সাড়ে আটটা। থানার গেটের পাশে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিলেন মা রাব্বানা বেগম (৬০)। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, এভাবে কান্নাকাটি করছেন কেন? ‘পোলাটারে বাড়ির সামনে থাইকা নিয়ে আইলো পুলিশ। মামলা হালকা কইরা দিব বইলা আমার কাছ থাইকা এক হাজার টাকা নিছে। এখন কইতাছে আরো চার হাজার টাকা লাগবো। মাইনষের বাসায় কাম কইরা খাই। এক খালার কাছ থাইকা এক হাজার টাকা আনছিলাম। সেইটা দিছি দারোগা বাশাররে। হে কয় আরো চার হাজার টাকা লাগবো। কন তো বাবা আমি টাকা পামু কই।
আপনার ছেলের কি অপরাধ ছিল প্রশ্ন করতেই তিনি বলে উঠলেন, আমার পোলাটা আজ একটা কাজের লাইগা বাইর হইছিলো। ওই সময় ওরে পুলিশে ধইরা নিয়া আইছে। এ কথা বলে থেমে গেলেন। এরপর আবারও আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্না শুরু করলেন তিনি ।
বুধবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার গেটে পুলিশের হাতে আটক সুজন (২২) নামে এক যুবকের ষাটোর্ধ্ব মা রব্বানা বেগম এই প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই তার আকুতির কথাগুলো জানাচ্ছিলেন।
কথা বলার সময় তিনি আশপাশে বারবার তাকাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন বাবাগো আমারে ভয় করছে। যদি আমার পোলাডারে কিছু হইয়া যায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার কাছে পুরো ঘটনা জানতে চাইলে এবার তিনি ভয় পেয়ে যান। কোনভাবেই নাম পরিচয় তিনি বলছিলেন না। বারবার বলছিলেন, ‘দারোগায় জানলে আমার পোলাডারে মাইরা ফালাইবো।’
এরপর সেই নারী সঙ্গে থাকা পুরনো বাটন ফোনে অন্য এক নারীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর কিছুটা স্বাভাবিক হন এবং এই প্রতিবেদকের কাছে তার ফোনটি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘খালাম্মা আপনার লগে কথা কইব।’ তার ফোনটি ধরে কানে লাগাতেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আনোয়ারা বেগম পরিচয় দিয়ে এক নারী বলে উঠলেন, ‘ভাইয়া উনি খুব গরিব মানুষ। আমার বাসায় কাজ করেন। তার ছেলে আজ বাসা থেকে বের হয়েছিল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এখন তার কাছে টাকা চাচ্ছে। তিনি আমার কাছে হাজার খানেক টাকা নিয়ে গিয়ে পুলিশকে দিয়েছেন। আবারো তারা নাকি টাকা চাচ্ছে। এবার সেই মহিলার কথায় আশ্বস্ত হয়ে বৃদ্ধা প্রতিবেদকের সাথে কথা বলা শুরু করলেন।
এরপর তিনি জানালেন তার ছেলের নাম সুজন। একটি প্রাইভেট হাসপাতালে মাস খানেক আগে চাকরি করতেন তিনি। কোনো এক কারণে তার চাকরি চলে গেছে। এখন তিনি বেকার। তাদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। সুজন তার পরিবারের সাথে মোহাম্মদপুরের আজিজ খান রোড এলাকায় থাকেন। তার বাবা মৃত জামিল মিয়া।
গত ২৫ দিন আগে স্বামী মারা গেছেন। সেই শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। এর মাঝে ছেলের বিপদ। বৃদ্ধা আরো জানালেন, তিনি অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। তার স্বামী পান বিড়ি সিগারেটের দোকান চালাতেন। মাস খানেক আগে স্ট্রোক করে মারা যান। ছেলেকে আটকের খবর শুনে সেই বিকেল থেকে থানার সামনে তিনি অবস্থান করছিলেন। পুলিশ তাকে কোনোভাবে থানার ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
রব্বানা বেগমের দাবি, ছেলেকে পুলিশ বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে এসেছে। সুজনের নামে কখনোই কোনো মামলা ছিল না। তবে গেল মাসে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের দিন একটি জরুরী কাজে বের হলে পুলিশ আটক করে রাজনৈতিক মামলায় চালান দিয়েছিল। পরে ২৫ দিন কারা ভোগ করে তিনি বের হন। এছাড়া তার নামে কোনো মামলা নেই।
এই নারীর সাথে কথা বলার ফাঁকেই পুলিশের সেই এসআই বাশার তাকে ফোন দিয়ে বসলেন। এরপর প্রতিবেদকের সাথে কথা থামিয়ে চলে গেলেন থানার ভেতরে। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এসে জানালেন, পুলিশের সেই দারোগা নাকি তার কাছে আরো ৪ হাজার টাকা চাচ্ছেন। বাসার তার ফোনে ফোন দিয়েছেন বিষয়টি যাচাই করার জন্য বৃদ্ধার ফোনটি হাতে নিয়ে বাটন চাপতেই ডায়ালকলে বাশার স্যার নামে ভেসে উঠলো। পরে সেই নারীর কাছ থেকে চলে আসার মুহূর্তে তিনি বারবার এই প্রতিবেদকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘বাবা পুলিশ কি আমার পোলাটার ছাইরা দিবো!’
সেই সময় সুজনের মায়ের পাশেই ছিল পপি আখতার এক নামে এক নারী। নিজেকে সুজনের ভাবি পরিচয় দিয়ে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সুজনকে আজ আমি মোবাইল ঠিক করতে দিয়ে ছিলাম। সেই কাজের জন্য বের হয়েছিল সুজন । পুলিশ তাকে আটকের সময় আমার ফোনটিসহ ধরে নিয়ে আসে। এখন আমরা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদকে ফোন করা হলে তিনি দাবি করেন, সুজন একজন চিহ্নিত ছিনতাইকারী এবং এলাকায় তিনি নিয়মিত ছিনতাই করেন। অভিযোগ থাকায় তাকে থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এবার ওসিকে পুরো ঘটনাটি জানালে তিনি প্রমাণ হিসেবে সেই নারীর বক্তব্য ও ভয়েস রেকর্ড চান এবং বলেন, এমন ঘটনা হলে সেই পুলিশকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরই সুজনকে ধরে নিয়ে আসা এবং তার মায়ের কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা সেই এসআই বাশারকে নিজের কাছে ডেকেছেন বলে ফোনের অপর প্রান্ত থেকেই প্রতিবেদককে জানান।
ওসি ঢাকা মেইলকে বলতে থাকেন, সুজন একজন ছিনতাইকারী। তার নামে তিনটি মামলা রয়েছে। একটি মোহাম্মদপুর থানায়, আরেকটি ধানমন্ডি থানায় এবং অন্যটি হাতিরঝিল থানায়। এরপর তার কাছে সেই মামলাগুলোর নাম্বার জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে পারেননি । পাশাপাশি এসআই বাসার যে সুজনের মাকে ফোন করেছিলেন থানা থেকে বিষয়টি যাচাই করার জন্য তার ফোন চেক করতে বলা হলে তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান।
এরপর সেই এসআই বাশারের ফোনে কল করা হলে তিনি ফোনটা ধরেই সরাসরি তিনি ঢাকা মেইলকে বলতে থাকেন, ‘আমি কারো কাছে কোন টাকা নেইনি এসব অভিযোগ মিথ্যা।’ একথা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর তাকে ৫ দফা ফোনে চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
রাত সাড়ে ১১ টার দিকে ভুক্তভোগী সুজনের মা রব্বানা বেগমের কাছে আবারো এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তার সাথে কথা বলে আসার পর তাকে আর থানার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ওসি তার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন বিষয়টি তাকে ফোনে জানিয়ে থানায় প্রবেশের কথা জানালে তিনি প্রবেশের চেষ্টা করেছেন কিন্তু তাকে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ওসির দাবি সুজন একজন ছিনতাইকারী। এ ব্যাপারে রব্বানা বেগম শংকর এলাকার যে বাসায় কাজ করেন সেই বাসার মালিক আনোয়ারা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, সুজনের মা অত্যন্ত গরিব। তিনি তার বাসায় কাজ করেন। রব্বানা বেগমের ছেলে সুজনের নামে কখনোই তিনি কোনো অভিযোগের কথা শুনেননি।
একই রাতে মোহাম্মদপুর থানার গেটে বিভিন্ন ভুক্তভোগের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। বেশ কয়েকজন জানান, বুধবার দুপুরের পর মোহাম্মদপুরের জেনেভা বিহারী ক্যাম্পে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। সেই সময় বেশ কিছু যুবককে আটক করা হয়। সেই যুবকের স্বজনরা সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মোহাম্মদপুর থানার গেটের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন। পরে কয়েকজন এই প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে তাদের স্বজনকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন কিন্তু বাকিদের ভাগ্যে কি জুটেছে জানা যায়নি।
জেনেভা ক্যাম্পে শাহজাহান নামের এক ব্যক্তির দোকানে এক যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করেন রাজা। বিকেলে তাকে তার মালিক দোকান থেকে চা-নাস্তা আনার জন্য টাকা দেন। এরপর তিনি দোকান থেকে বের হয়ে নাস্তা আনতে যান। কিন্তু এরপর থেকে তার কোনো হাদিস মিল ছিল না। পরে মালিক শাহজাহান জানতে পারেন রাজাকে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
বুধবার রাত নয়টার দিকে শাহজাহানের সাথে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের। তখন তিনি জানান, ছেলেটার বিরুদ্ধে আগের কোনো অভিযোগ নেই। আজ তিনি তাকে নাশতা কেনার জন্য দোকান থেকে বাইরে পাঠিয়েছিলেন এরই মাঝে শোনেন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। এরপর থেকে তার বাবা ও ভাইকে নিয়ে তিনি থানার সামনে এসে ভিড় করছেন। কিন্তু তখনও তাকে ছাড়া হয়নি। এরপর রাত পৌনে একটার দিকে রাজার ভাই ফোন করে প্রতিবেদককে জানান তার ভাইকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। রাজার মতোই জেনেভা ক্যাম্প থেকে বুধবার বিকেলে আটক করা হয়েছিল রানাকে। তার বাবাও সেদিন থানার সামনে হাজির হয়েছিলেন। পরে রাত একটা দিকে রানার বাবা আব্দুর রহিমের সাথে কথা হলে তিনি জানান তার ছেলেকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।
তার আগে তিনি জানিয়েছিলেন, তার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে আসে বলেও তিনি জানান।
এমআইকে/একেবি