images

জাতীয়

কর্ণফুলী টানেলে বাইকসহ চলবে না যেসব যান

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:০৩ পিএম

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের পর উদ্বোধনের অপেক্ষায় আরেকটি মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে চালু হতে যাওয়া এই টানেল দিয়ে সব ধরনের গাড়ি চলতে পারবে না। বিপদজনক ও ঝুঁকি বিবেচনায় টানেল দিয়ে কিছু যান চলাচলে অনুমতি দেবে না সরকার। দাহ্য পদার্থবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চলাচল করতে পারবে না এই টানেলে। সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে মোটরসাইকেলও।

ইতোমধ্যেই টানেলে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সেতু বিভাগ। যদিও টানেলের খসড়া তালিকায় মোটরসাইকেলের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। মোটরসাইকেল যেন চলাচলের অনুমতি না পায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে বলে সেতু বিভাগসহ একাধিক সূত্রে নিশ্চিত করেছে।

চট্টগ্রামে হচ্ছে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, যা বঙ্গবন্ধু টানেল নামেও পরিচিত। কেউ কেউ কর্ণফুলী টানেল নামেও বলে থাকেন। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। এরপর শুরু হবে যান চলাচলের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে টানেলের টোল নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে। টোলের তালিকায় মোটরসাইকেলসহ ১২ ধরনের যান চলাচলের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। এটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ তেমনি দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।

চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই সুড়ঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তের চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এই টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দুই লেনেই দ্রুতগতিতে যান চলাচল করবে। ফলে টানেলে কোথাও থামার সুযোগ থাকবে না। মোটরসাইকেল একটি ঝুঁকিপূর্ণ যান হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়। তাই টানেলে যেন মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হয়। সেজন্য একটি প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তিন চাকার গাড়ি চলাচলের বিষয়টি আপাতত বিবেচনায় নেই। পাশাপাশি টানেলের সুরক্ষায় দাহ্য পদার্থবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানও টানেলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি করেছে সেতু বিভাগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না পেলেও টোলের তালিকায় মোটরসাইকেল আছে। পরে কখনো যদি চলতে দেওয়া হয় তখন শুধু মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা করে টোল নির্ধারণ করা হবে না। তাই মোটরসাইকেল চলুক আর না চলুক, টোলের তালিকায় মোটরসাইকেল থাকছে।

সেতু বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, টোলের তালিকায় থাকলেও টানেলে হয়তো মোটরসাইকেল চলবে না। মোটরসাইকেল না চলার বিষয়ে একটি প্রস্তাব তোলা হয়েছে। আশা করছি, প্রস্তাবটি পাস হবে।

টানেলে মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, টানেল একটি এক্সক্লুসিভ বিষয়। মোটরসাইকেল কখনোই দূরপাল্লার বাহন হতে পারে না। তাই এখানে মোটরসাইকেল না চালানোই ভালো।

টানেলে যান চলাচলের চাপ কেমন হবে, তা জানতে ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, টানেল চালুর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। এর মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যান। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গত নভেম্বর মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত মাসে সারা দেশে মোট ৪৬৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫৪ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ১৯৪টি দুর্ঘটনার কারণ মোটরসাইকেল। এটা মোট দুর্ঘটনার ৪১.৯০ শতাংশ।

কর্ণফুলী নদীর ওপর চট্টগ্রাম নগর অংশে বর্তমানে দুটি সেতু রয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কালুরঘাট রেল সেতুর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। আর শাহ আমানত সেতুর ওপর দিয়ে কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চলাচল করে। টানেলটি শাহ আমানত সেতু থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত। এজন্য গাড়িভেদে টোলের হার আলাদা। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোলের হার শাহ আমানত সেতুর চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি। শাহ আমানত সেতুর চেয়ে টোল বেশি হলে টানেলের ভেতর দিয়ে প্রত্যাশিত গাড়ি চলাচল নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোল অনুযায়ী, টানেলের মধ্যে দিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা করে। শাহ আমানত সেতুতে প্রাইভেট কারের জন্য ৭৫ টাকা এবং জিপের জন্য ১০০ টাকা দিতে হয়। আর মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। শাহ আমানত সেতুতে এই হার ১০০ টাকা। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। যদিও শাহ আমানত সেতুতে নেওয়া হয় যথাক্রমে ৫০ ও ১৫৫ টাকা। টানেলে দিয়ে যেতে হলে ৫ টনের ট্রাককে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাককে ৫০০, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তবে শাহ আমানত সেতুতে টোল নেওয়া হয় যথাক্রমে ১৩০, ২০০ ও ৩০০ টাকা। ট্রেইলরের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ টাকা। শাহ আমানত সেতুতে এ হার ৭৫০ টাকা।

টানেল প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, টানেলের নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সহজ ও আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, শিল্পকারখানার বিকাশ এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের ফলে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, তা বেকারত্ব দূর করাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া জিডিপিতেও রাখবে ইতিবাচক প্রভাব। টানেল চালু হলে শিল্পায়ন, পর্যটনশিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রফতানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে।

ডব্লিউএইচ/এমআর