images

জাতীয়

বছরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ডেঙ্গু

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:৪৮ পিএম

বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সাল জুড়েই দাপট দেখিয়েছে রোগটি। সাধারণত বর্ষার আগে ও পরে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও এ বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই ভুগিয়েছে মশাবাহিত এ রোগটি। এতে আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা- দুটোতেই রেকর্ড হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের (এমআইএস) তথ্য মতে, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬২ হাজার ৩২১ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৬১ হাজার ৬৮১ জন। আর এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৮১ জন মারা গেছেন।

আক্রান্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই ৩৯ হাজার ১৮৮ জন হাসপাতালের ভর্তি হয়েছিলেন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭৩ জন। সাধারণত ডেঙ্গু আক্রান্তদের সিংহভাগ রাজধানীতেই থাকেন। তবে এ বছর ছিল আক্রান্তদের বড় অংশ ছিল ঢাকার বাইরের, ২৩ হাজার ১৩৩ জন। যার মধ্যে ১০৮ জন মারা গেছেন।

রাজধানী ঢাকা বাদে বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে ঢাকা বিভাগে ৪ হাজার ১০১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ হাজার ১৯ জন, চট্টগ্রামে ৯ হাজার ৯৩ জন, খুলনায় ৩ হাজার ৩৪৮ জন, রাজশাহীতে ২ হাজার ১০৮ জন, রংপুরে ১৭৪ জন, বরিশালে ৩ হাজার ১৬৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ১২৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন যথাক্রমে ২, ৬, ৬৯, ১২, ৭ এবং ১২ জন। এর মধ্যে রংপুর ও সিলেট বিভাগে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

হটস্পট কক্সবাজার

জেলাভিত্তিক তথ্যানুসারে, ঢাকা মহানগরীর পর সর্বাধিক রোগী চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায়। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে কক্সবাজারে মোট ২ হাজার ৬৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন। তবে স্থানীয় হিসেবে সংখ্যাটি আরও বেশি।

এর কারণ হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর ও ঘনবসতিকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এই ক্যাম্পের জন্যই কক্সবাজার ডেঙ্গুর হটস্পটে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন নির্মাণ কাজকেও দায়ী করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মমিনুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে হয়তো ডেঙ্গু প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা হয়তো মশারি ব্যবহার করে না। যদিও মশারি দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে ঘনবসতি রয়েছে। মশা জন্মানোর জন্য পানি জমে থাকাসহ যে ধরনের পরিবেশ দরকার সেটাও হয়তো সেখানে ছিল। যে জন্য এমনটি হয়েছে। আর পৌর এলাকাতেও বেশকিছু প্রভাবক ছিল। যেমন- কক্সবাজার শহরের সড়কগুলো সংস্কার করা হচ্ছে। সেখানে অনেক খানা-খন্দ রয়েছে। অনেক স্থানে নালাগুলো বন্ধ হয়ে ছিল। সেখানে অনেক সময় পানি জমে থাকতো। এসব কারণে সম্ভবত বেশি ছড়িয়েছে।

মাসভিত্তিক যেভাবে বেড়েছে রোগী

২০২২ সালে এমন কোনো মাস নেই যখন ডেঙ্গু নিয়ে কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। তবে বছরের শেষ ছয় মাসে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন এবং মে মাসে ১৬৩ জন। এ সময়ের মধ্যে কোনো মৃত্যু হয়নি। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে জুন থেকে। জুনে মোট ৭৩৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এ মাসেই প্রথম মৃত্যু ঘটে। পরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা। জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন ভর্তি হয়, আগস্টে ৩ হাজার ৫২১, সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৯১১, অক্টোবরে সর্বোচ্চ ২১ হাজার ৯৩২ জন, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৬৩ জন ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর মৃত্যু হয় যথাক্রমে জুলাইয়ে ৯ জন, আগস্টে ১১, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টোবরে ৮৬, নভেম্বরে সর্বোচ্চ ১১৩ এবং ডিসেম্বরে ২৭ জনের।

মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব কর্মসূচি

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এডিস মশা নিধন। এর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর। এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতর যৌথ ও এককভাবে নানা কর্যক্রম পরিচালনা করে। এর অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি দুই দফা জরিপ পরিচালনা করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রাক-মৌসুম এডিস জরিপের তথ্য মতে, ঢাকায় ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ কিউলেক্স ও অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ মশা এবং ৫ দশমিক ১০ শতাংশ এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে। অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০টি দলের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি স্থানে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মেঝেতে জমানো পানিতে সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, প্লাস্টিক ড্রামে ২১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, প্লাস্টিক বালতিতে ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ, পানির ট্যাংকিতে (সিমেন্ট) ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ফুলের টবে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ, মেটাল ড্রামে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, প্লাস্টিক মগ, পাত্র, বদনাতে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, পানির ট্যাংক (প্লাস্টিক) ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং অন্যান্য বস্তুতে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে নির্মানাধীন ভবনে ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ, বহুতল ভবনে ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ একক ভবনসমূহে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, সেমিপাকা বা বস্তি এলাকায় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, এবং পরিত্যক্ত (ফাকা) জমিসমূহে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ মশার লার্ভা পরিলক্ষিত হয়।

এদিকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে জনসচেতনা তৈরি লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচারণা, ওষুধ ছিটানো, ধোঁয়ার ব্যবহার, লার্ভা বিরোধী অভিযান, এমনকি জরিমানার মতো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে চার মাসব্যাপী বিশেষ অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঝুঁকিপূর্ণ ৭ ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে তারা। এ সময় জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) চিরুনি অভিযানসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কাজ করছে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও।

হাসপাতালে হিমশিম ও মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়হীনতা

সারা বছর মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও এতে কতটা লাভ পাওয়া গেছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অনেকের মতে এসব কার্যক্রম বহুলাংশেই পণ্ডশ্রম। ফলে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। রোগীর চাপে অক্টোবর-নভেম্বরে সেবা দিতে হিমশিম খায় হাসপাতালগুলো।

এছাড়া ডেঙ্গু সংক্রান্ত দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীতাও দেখা যায়। যেমন- এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের হলেও রোগী সেবার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। যেহেতু ডেঙ্গুর প্রভাব হাসপাতাল ও রোগী মৃত্যুর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তাই এ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। একপর্যায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি বা হ্রাসের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো হাত থাকে না। স্বাস্থ্য খাত চিকিৎসা দিতে পারে, তাদের কাজ মশা মারা নয়।

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার আহ্বান জানান। ডেঙ্গুসহ সব ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘এক দেশ এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ জরুরি বলে মত দেন তারা। 

এমএইচ/এজে