ওয়াজেদ হীরা
২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৩৪ এএম
কোটি বাঙালির স্বপ্ন ছোঁয়া পদ্মা সেতুর পর একই বছরে উদ্বোধন হচ্ছে উন্নয়নের আরেক নাম মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করছে দেশ আর ইতিহাসে উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক রচিত হচ্ছে। প্রথম বিদ্যুৎ চালিত মেট্রোরেলের যাত্রার মাধ্যমে উন্নয়নের আরও একধাপ এগিয়ে গেলো দেশ। সেই সাথে দেশের নগর পরিবহন ব্যবস্থায় একটি অনন্য সংযোজন হতে যাচ্ছে এই মেট্টোরেল। দুর্ভোগ কমবে, যানজট কমিয়ে বাঁচাবে সময়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) সকালে দেশের প্রথম মেট্রোরেল পরিষেবার প্রথম ধাপের উদ্বোধন করবেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি আধুনিক মেট্রোরেল ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে চলেছে। রেলযাত্রা শুরুর দীর্ঘ ১৬০ বছর পর নতুন দুয়ারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। প্রযুক্তি-নির্ভর বিদ্যুৎ চালিত এই রেল যোগাযোগের নাম মেট্রোরেল। এ অঞ্চলে প্রথম রেলপথের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমল ১৯৬২ সালে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন, লোকমোটিভ ব্যবহার করে এবার বিদ্যুতে চলবে ট্রেন।
স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, মেট্রোরেল উদ্বোধনের মাধ্যমে জনবান্ধব সরকারের আরেকটি সাফল্য অর্জিত হলো। মেট্রোরেলের যাত্রা ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ করবে। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশবাসীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের গর্ব ও আকাক্সক্ষার প্রতীক মেট্রোরেল বাংলাদেশের নগর গণপরিবহন ব্যবস্থায় একটি অনন্য মাইলফলক। আগামী প্রজন্মের জন্য ঢাকা মহানগরীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় আমরা এগিয়ে যাব নিরন্তর- ইনশাআল্লাহ।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘লাল ফিতা কেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরীর সবচেয়ে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার প্রথম যাত্রী হবেন।
সকাল ১১টায় উত্তরার দিয়াবাড়িতে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে ডিএমটিসিএল এবং পুলিশ-র্যাব সদস্যরা অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
উদ্বোধনের পর রুটের মধ্যবর্তী স্টেশনে কোনো স্টপেজ ছাড়াই উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে। পরের দিন (বৃহস্পতিবার) থেকে যাত্রীরা ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন। প্রতিটি ট্রেন প্রথম কয়েক দিনের জন্য প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে একটু বেশি সময় যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করবে কারণ নগরবাসী এই নতুন পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নয়। প্রাথমিকভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ছয়টি বগি বিশিষ্ট ১০ সেট ট্রেন চলাচল করবে। আপাতত এই রুটে ধীরগতিতে ট্রেন চলবে। এ পর্যায়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলবে, পরে চলাচলের সময় বাড়ানো হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনের সংখ্যা বাড়নো হবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেল বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রথমবারের মতো একটি অভিজ্ঞতা হবে। তাই যাত্রীদের টিকিট ব্যবস্থা এবং পরিষেবা ব্যবহার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। যাত্রীরা যখন মেট্রোরেলের সঙ্গে পরিচিত হবে তখন আমরা মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে ট্রিপ, ট্রেন এবং স্টপেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করব।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। রাজধানী ঢাকা যাত্রীদের জন্য মেট্রোরেলের সঙ্গে সবচেয়ে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা পেতে যাচ্ছে। মেট্রোরেল উদ্বোধনের ফলে শুধু মহানগরীর যানজটই কমবে না, সরকারের সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। পূর্ণ গতিতে ট্রেন চলাচল শুরু হলে প্রতি সাড়ে তিন মিনিট অন্তর একটি ট্রেন চলবে। প্রতিটি স্টেশনে, যাত্রীদের ওঠা ও নামা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ট্রেনটি অপেক্ষা করবে। প্রতিটি ট্রেন ২,৩০০ জন যাত্রী নিয়ে ঘন্টায় ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবে বাঁকযুক্ত এলাকায় গতি কম হবে।
এ অঞ্চলে প্রথম রেলপথের যাত্রাটা অনেক দিন আগে। সেই ব্রিটিশ আমল ১৯৬২ সালে যখন ট্রেন যাত্রা করে তখন মানুষ ট্রেন বলতে বুঝত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মাধ্যমে ধীরে চলা একটি রেলগাড়ি। আশির দশকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন বাদ দিয়ে শুরু হয় ডিজেল চালিত লোকমোটিভ (ইঞ্জিন) দিয়ে ট্রেন পরিচালনা। রেল বলতে বাংলাদেশের মানুষ এখন আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল ট্রেনকে বুঝেন। কিন্তু মেট্রোরেল কী সেই অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষের এখনো হয়নি। যারা বিদেশের বিভিন্ন দেশে দেখেছেন তাদের একটা অভিজ্ঞতা থাকলেও দেশের প্রেক্ষাপটে এটি একেবারেই নতুন। ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬’র মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার উড়াল পথে চলাচল করবে এই ট্রেন। এই ট্রেনে আসন সংখ্যার থেকে দাঁড়িয়ে বেশি যাত্রী চলাচল করতে পারবে। মাত্র ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে পৌঁছানো যাবে মতিঝিল।
মেট্রোরেলে দুই ধরনের টিকিট নিয়ে চলাচল করা যাবে। প্রথমটি সিঙ্গেল জার্নির জন্য, দ্বিতীয়টি এমআরটি পাস (স্থায়ী টিকিট) পারমানেন্ট জার্নির জন্য। সিঙ্গেল জার্নির জন্য যাত্রীকে প্রতিবার যাত্রার আগে টিকিট কাটতে হবে। যাত্রা শেষে টিকিট স্টেশনের স্বয়ংক্রিয় দরজায় জমা দিয়ে আসতে হবে। এই টিকিট জমা না দিলে দরজা খুলবে না, ফলে যাত্রী স্টেশন থেকে বের হতে পারবে না। এমআরটি পাসের জন্য যাত্রীকে একবার একটি টিকিট কিনলেই হবে। টাকা শেষ হলে রিচার্জ করতে হবে। এই টিকিট যাত্রীকে স্টেশনে জমা দিতে হবে না। যাত্রীর কাছেই এই টিকিট থাকবে।
এমআরটি লাইন-৬ বা দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল লাইনে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে। প্রতিটি স্টেশনে কনকোর্স লেভেল বা যাত্রী পারাপারের ব্যবস্থা থাকবে। এই লেভেলে ওঠার জন্য প্রতিটি স্টেশনে সিঁড়ি, লিফ্ট এবং এস্কেলেটর থাকবে। এই সিঁড়ি, লিফ্ট এবং এস্কেলেটর ব্যবহার করে শুধুমাত্র মেট্রো ট্রেন চলাচলকালীন কনকোর্স লেভেল দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়া যাবে। তবে পেইড জোন এলাকায় ও প্লাটফর্মে যাওয়া যাবে না। পথচারীগণ রাস্তা পারাপারের জন্য এই ব্যবস্থাকে ফুট ওভারব্রিজের অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মেট্রোরেল পরিচালনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে উত্তরা ডিপো এবং মতিঝিল এলাকায় দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন থাকবে। মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির দুটি পৃথক সার্কিট এবং উত্তরা রিসিভিং সাবস্টেশনে পিজিসিবি এর টঙ্গী গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির একটি সার্কিট ও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) উত্তরা গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির অপর একটি সার্কিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।
উভয় রিসিভিং সাবস্টেশনে ব্যাকআপ হিসেবে একটি করে অতিরিক্ত ট্রান্সফর্মার থাকবে। পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থিত ডেসকোর ৩৩ কেভি সাবস্টেশন থেকে শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনে ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকবে। ফলে মেট্রোরেল পরিচালনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এখন উত্তরা থেকে আগারগাঁও চালু হলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আগামী বছর ডিসেম্বরে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত যুক্ত হওয়ায় এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। এরমধ্যে জাইকা ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে আর সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
ডব্লিউএইচ/এএস