images

জাতীয়

যাদের হারিয়েছি

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:২৬ এএম

প্রাকৃতিক নিয়মেই সমাপ্তির পথে ২০২২ সাল। নানা ঘটনায় আলোচিত এ বছরের প্রাপ্তির খাতায় যেমন অসংখ্য বিষয় আছে, তেমনই আছে হারানোর দীর্ঘ তালিকা। মহাকালের অতল গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার এই তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন দেশবরেণ্য ব্যক্তি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংগীত, চলচিত্র ও ক্রীড়াঙ্গনের এসব মানুষ আমাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী
২০২২ সালের ১৯ মে ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গ্রন্থকার, সাহিত্যিক, সংবাদিক ও কলাম লেখক। ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা তিনি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও ছিলেন এই গুণী মানুষ।

আবদুল গাফফার চৌধুরী বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন- মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। আবদুল গাফফার চৌধুরী পরিপূর্ণভাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫০ সালে। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে আবদুল গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০টি। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘একজন তাহমিনা’ ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ ও ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’।

কাজের স্বীকৃতি হিসেব বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী
বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। এর আগে তিনি সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রখ্যাত এই রাজনীতিবিদ ১১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। জীবনের ৬৬ বছরই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী তিনি। ১৯৫৬ সাল থেকে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৯ থকে ১৯৭৫ সময়কালে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন।

১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে টেকনোক্র‍্যাট কোটায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ফরিদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনেও তিনি এ জেলা থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন।

২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক বর্ষসেরা নারী নির্বাচিত হন সাজেদা চৈৗধুরী। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক ও ভাষাসৈনিক আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক ১২ বার জাতীয় বাজেট ঘোষণার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করছেন তিনি। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানী ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ উকিল মিয়া ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সিলেট শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সিলেট গণভোট ও পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তার মা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী এবং সুফী কবি সৈয়দ আশহর আলী চৌধুরীর নাতনী। ১৪ ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ছিলেন।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের নানা উচ্চ পদে কর্মরত থাকার পর ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন লেখকও হিসেবে খ্যাতিমান। তার ২১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃত এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
গাজী মাজহারুল আনোয়ার একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার। স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন এই কিংবদন্তি সুরকার। বিবিসি বাংলা তৈরি করা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকার তিনটি গানই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা।

প্রখ্যাত এই সরকার ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বেতার, টেলিভিশন, সিনেমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার গান রচনা করেছেন। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রের জন্য। ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র নান্টু ঘটক ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১টি।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।

কাজী আনোয়ার হোসেন
কাজী আনোয়ার হোসেন একজন লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, এবং জনপ্রিয় মাসুদ রানা ধারাবাহিকের স্রষ্টা। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিল।

২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন।

১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই লেখক। তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন।

শর্মিলী আহমেদ
শর্মিলী আহমেদ প্রখ্যাত টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ১৯৬৪ সালে তিনি অভিনয়ে কর্মজীবন শুরু করা শর্মিলী আহমেদ মা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দেশ জুড়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

২০২২ সালের ৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। শর্মিলী আহমেদের প্রকৃত নাম মাজেদা মল্লিক। ১৯৪৭ সালের ৮ মে তার জন্ম।

এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী অভিনয় শুরু করেন মাত্র চার বছর বয়সে। প্রায় ৪০০ নাটক ও ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়জীবনে মায়ের চরিত্রে এত বেশি অভিনয় করেছেন যে বিনোদন অঙ্গনে তিনি সবার কাছে ‘মা’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সবাই তাকে ‘শর্মিলী মা’ বলেই ডাকত। তার সাবলীল অভিনয়ে বাঙালি নারীর চরিত্র ফুটে উঠেছে।

মোশারফ হোসেন রুবেল
মোশারফ হোসেন রুবেল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড়। প্রায় তিন বছর ধরে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন জাতীয় দলের এ বাঁহাতি স্পিনার। অবশেষে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।

রুবেলের জন্ম ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায়। তিনি বামহাতি ব্যাটসম্যান এবং বামহাতি অর্থোডক্স বোলার।

এমএইচ/এইউ