images

জাতীয়

স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক পদ্মা সেতু

ওয়াজেদ হীরা

২১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৫৯ এএম

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ২১ বছর আগে ২০০১ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকেই এর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, দুর্নীতির অভিযোগ, নিজেদের টাকায় এত বড় সেতু বানানো সম্ভব না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গুজবসহ আরও কত ষড়যন্ত্র। আর এসব ষড়যন্ত্র ও অভিযোগের আড়ালে প্রশ্ন তোলা হয় বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে। প্রশ্ন তোলা হয় আমাদের আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে নিজেদের খরচে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ২৫ জুন ছিল সেই ইতিহাস রচনার দিন। বাঙালির আত্মবিশ্বাস, সক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক এই পদ্মা সেতু।

২০২২ সালের ২৫ জুন বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল প্লাজায় নিজ হাতে টোল দিয়ে সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন। বেলা ১২টার দিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও মুরাল-১ উন্মোচন করেন। এরপরই প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়ি ছুটে চলে প্রমত্তা পদ্মার ওপর দিয়ে। সৃষ্টি হয় ইতিহাস। যে পদ্মা পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো তা মাত্র কয়েক মিনিটেই পার।

বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা এই নদীতে সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জন্য এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। উদ্বোধনের পর মাত্র ছয় মাসেই পাল্টে গেছে এসব জেলার মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারা।

সেতু উদ্বোধনের দিন সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির ভাষা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার; দারুণ সূর্য হবো, লিখবো নতুন ইতিহাস।’

সত্যিই তাই। যে বাংলাদেশকে বলা হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিজের টাকায়, নিজেদের চেষ্টায় এত বড় অসাধ্য সাধন করেছে। তাই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক।

স্বপ্নটা দেখা শুরু হয়েছিল সেই ২০০১ সালে। ওই বছরের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জায়ামাত জোট। ধীরে ধীরে গতিহীন হয়ে পড়ে প্রকল্পটি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। কনসালটেন্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সরকার। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে যায় বিশ্বব্যাংক। সরকারও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আবেদন বিশ্বব্যাংক থেকে ফিরিয়ে নেয়। যদিও পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

নানা অভিযোগ, ষড়যন্ত্র ও চাপ উপেক্ষা করে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। ওই বছরের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। এরমধ্যে দেশের বড় বড় অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতি বলে অভিহিত করে।

কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান। আর শেষ স্প্যান বসে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সালে। দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু।

৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।

নদীতে ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু আর দুই পাশের সড়ক মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা এই সেতু। মূল সেতু নির্মাণে কাজ করে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুর কাঠামো।

সেতুটি উদ্বোধনের পরদিন সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। শুরুতে সেতুটি দেখতে সাধারণ মানুষের হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি মানুষের ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হয়।

সেতুর ওপর গাড়ি থামিয়ে ভিডিও করা ও সেলফি তোলার হিড়িক পড়েছিল। পদ্মা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে পদ্মা সেতুর ওপর যানবাহন দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে ছবি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সেতু কর্তৃপক্ষ।

পরবর্তীতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সাশ্রয়ী মূল্যে স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘুরে দেখানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। ২২ জুলাই পর্যটন করপোরেশনের এই ভ্রমণ প্যাকেজ ট্যুরের উদ্বোধন করা হয়।

এই সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে এসেছে নতুন গতি। পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায়। এসব জেলায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে বড় বড় কোম্পানিগুলো।

২১টি জেলায় নতুন করে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, পর্যটন, কৃষি ও আইসিটি খাতে বড় বিনিয়োগের কাজ শুরু করেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পদ্মা সেতু দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে। আর এই সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

সর্বোপরি পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এক অগ্রগতি।

ডব্লিউএইচ/এইউ