জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
১০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:১৭ পিএম
‘কী হবে ১০ ডিসেম্বর’ গত কিছু দিন ধরে মুখে মুখে ছিল এই প্রশ্ন। বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ এবং ক্ষমতাসীন দলের এদিন মাঠে থাকার ঘোষণায় জনমনে দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে শেষ পর্যন্ত উভয় দল তাদের কর্মসূচি পালন করলেও কোথাও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এতে ১০ ডিসেম্বরকেন্দ্রিক জনমনে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল তা আপাতত কেটে গেছে।
শনিবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকা শহর কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া এদিন রাজধানীবাসী বের হননি। দিনভর রাস্তায় চলেনি গণপরিবহন। বিএনপি গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করেছে। আর আওয়ামী লীগ পাড়ায়-মহল্লায় দিনভর মহড়া দিয়ে তাদের শক্তির জানান দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গোটা রাজধানীতে গড়ে তুলে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। এতে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কেটে যায় উৎকণ্ঠার দিনটি।
শনিবার বেলা ১১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। দিনভর নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ চললেও সবশেষ দুই দিনের কর্মসূচি ও নির্দলীয় সরকারসহ ১০ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আয়োজন।
সমাবেশের আগের দিন বিকেলের দিকে ভ্যানু ব্যবহারের অনুমতি পায় বিএনপি। ফলে সমাবেশ কতটা সফল হবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিলেও শুক্রবার সন্ধ্যার আগে পুরো মাঠ লোকেলোকারণ্য হয়ে ওঠে। রাতে আশপাশের এলাকার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দিনের আলো ফুটতেই মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে বিএনপির সমাবেশে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের মাঠের বাইরে সড়কে অবস্থান নিতে দেখা যায়। এতে করে একদিকে কমলাপুর স্টেডিয়ামের সামনের পুরো সড়ক, অন্যদিকে জনপদ মোড়সহ আশপাশের এলাকা অনেকটা ভরে যায়। বিএনপি দাবি করছে, লাখ লাখ কর্মী তাদের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগে থেকেই এদিন মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছিল। শনিবার সকাল থেকেই পাড়া-মহল্লায় সতর্ক অবস্থান নেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। কোথাও কোথাও লাঠি হাতে নিয়ে কিংবা মোটর সাইকেলে মহড়াও দেন। তারা দিনভর নিজেদের শক্তির জানান দিলেও সরাসরি কোথাও বাধা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুরো ঢাকাকে অনেকটা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়। বিশেষ করে সমাবেশস্থলের আশপাশের এলাকা ও নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
৩২ হাজার পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, আর্মস পুলিশ, আনসার সদস্যদেরও মাঠে সক্রিয় দেখা গেছে। আকাশ থেকে র্যাবের হেলিকপ্টারে টহল দিতে দেখা গেছে।
উৎকণ্ঠার শুরু যেভাবে
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সব বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে করেছে বিএনপি। সবশেষ ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করার দিন ধার্য করা হয়।
শুরুর দিক থেকে সমাবেশকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। কোথাও গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া, কোথাও সমাবেশের ভ্যানু নিয়ে জটিলতা, কোথাও আবার হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও সব সমাবেশ করে ঢাকায় কর্মসূচি পালন নিয়ে অনেকটা চাপে পড়ে যায় বিএনপির হাইকমান্ড।
কারণ প্রতিটি সমাবেশের আগের দিনই বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়ে নেন। দূরদূরান্ত থেকে কেউ কেউ চিড়া-মুড়ি নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। ঢাকায়ও আসা নেতাকর্মীদের জন্য খিচুড়িসহ নানা আয়োজন করা হয়। সবশেষ সমাবেশে নেতাকর্মীরা বসে পড়তে পারেন এমন শঙ্কার দেখা দেওয়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার ও প্রশাসনের লোকজন।
শুরুর দিকে ঢাকার মধ্যে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে বক্তব্য দিলেও এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে সোহওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বিএনপি নয়াপল্টন ছাড়া সমাবেশ না করার ব্যাপারে অনড় অবস্থানের কথা জানায়।
এক পর্যায়ে গত বুধবার বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর নয়াপল্টনের আশা ভণ্ডুল হয়ে যায়। সেখান থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি কয়েকশ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে কার্যালয় তল্লাশি করে ককটেল উদ্ধার করা হয় বলে দাবি করে পুলিশ।
এমন পরিস্থিতিতে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে কার্যালয়ে ঢুকতে না দিয়ে পুরো নয়াপল্টনের নিয়ন্ত্রণ নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমন অবস্থার মধ্যে হঠাৎ বৃহস্পতিবার রাতে আটক করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে। পরে শঙ্কা দেখা দেয় সমাবেশ হওয়া নিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত দলটির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত নেয় সমাবেশ করার।
শুরু থেকে সমাবেশ ঘিরে বিশৃঙ্খলতার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া বিএনপি অবশ্য সমাবেশ শেষ করতে গিয়ে নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফেরার নির্দেশনা দেয়।
ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের সভাপতি আমানউল্লাহ আমান তার বক্তব্যে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এখানে সমাবেশ করেছি। শান্তিপূর্ণভাবেই এ সরকারের পতন ঘটাবো। নেতাকর্মীদের বলবো, সমাবেশ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাবেন। এটা আমাদের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি বলছি।’
যদিও জনমনে শঙ্কা ছিল সমাবেশ শেষে ফেরার পথে হামলা হতে পারে। তবে কোথাও কিছু ঘটেনি। ফলে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে উৎকণ্ঠার আপাতত শান্তিপূর্ণ অবসান ঘটেছে।
বিইউ/জেবি